ম্প্রতি শেষ হয়ে গেল টোকিও অলিম্পিক ২০২০। মহামারীর পরিস্থিতিতে একটু দেরি করে অনুষ্ঠিত হলেও অলিম্পিক শুরু মানেই তাকে ঘিরে খেলাপাগল মানুষের উৎসাহের অন্ত থাকে না। প্রতিদিন প্রায় কয়েক হাজার প্রতিযোগীর সাথে ভারতীয় প্রতিযোগীর প্রতিদ্বন্দ্বিতার টানটান উত্তেজনা, রোজ সকালে উঠে খবরের কাগজে তার বিস্তারিত বর্ণনা– এগুলোই যেন কদিন আগে আমাদের ডেইলি রুটিনে পরিণত হয়েছিল। তাছাড়া এবারের অলিম্পিকে ভারতের সাত সাতটা পদক জয়, সেও ভারতবাসী হিসেবে আমাদের কাছে কম গর্বের নয়। কিন্তু এই সবের মধ্যে আমাদের সবার নজর এড়িয়ে ঘটে গেছে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। যা আবারও প্রমাণ করেছে জাপানের নাগরিকরা গোটা পৃথিবীর থেকে কতটা এগিয়ে।

বিশ্বের ক্রীড়াজগতের ইতিহাসে প্রথমবার টোকিও অলিম্পিকের প্রায় পাঁচ হাজার মেডেল তৈরি করা হল ই-বর্জ্য থেকে। ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা সংক্ষেপে ই-বর্জ্য, নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এইধরনের বর্জ্যের উৎস মূলত ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ। সাধারণত ফেলে দেওয়া মুঠোফোন, কম্পিউটার, রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশনসহ নানারকম ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম থেকে এইসব ই-বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। ২০১৬ সাল নাগাদ পৃথিবীজুড়ে জমা হয়েছে প্রায় ৪৪.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন ই-বর্জ্য। প্রতি বছর এই বর্জ্যের পরিমাণ ৩-৪ শতাংশ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এইসব ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের চাহিদা থাকলেও এগুলি ফেলে দেওয়ার পর যে বিপুল পরিমাণ ই-বর্জ্য তৈরি হয়, তা প্রক্রিয়াকরণের পরিকাঠামো খুবই দুর্বল। ফলে এইসব ই-বর্জ্য থেকে তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের ফলে যেমন পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি পরোক্ষে তা সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করছে।

ই-বর্জ্যের স্তূপ

প্রাচীন গ্রীসে অলিম্পিক গেমস যখন শুরু হয়েছিল তখন বিজয়ীদের উৎসাহ দিতে তাদের মাথায় পরিয়ে দেওয়া হত জলপাই গাছের পাতা আর কাণ্ডে নির্মিত জয়মাল্য। এই সুসজ্জিত জয়মাল্য ছিল খেলোয়াড়দের বীরত্বের প্রতীক। তারপর সময় পাল্টেছে, পাল্টেছে মানুষের চিন্তাধারাও। এখন অলিম্পিকের কোনো প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হওয়া প্রতিযোগীদের যেভাবে সোনা, রুপো ও ব্রোঞ্জ দেওয়ার রীতি প্রচলন রয়েছে, তার সূত্রপাত ১৯০৪ সালের অলিম্পিক গেমস থেকে।

২০২০র অলিম্পিক পরিচালনা করার দায়িত্ব জাপান পায় ২০১৭ সালে। দায়িত্ব পেয়েই জাপানের অলিম্পিক কমিটি ‘Tokyo 2020 Medal Project: Towards an Innovative Future for All’ নামে একটি বোর্ড গঠন করে। লক্ষ্য ছিল একটাই! জাপান শহর পৃথিবীর বুকে যে কয়েকটা জিনিসের জন্য বিখ্যাত তার অন্যতম একটি হল ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি তৈরির কর্মস্থল হিসেবে। ক্যানন, নিকন, সোনি, ইয়ামাহা, ক্যাসিও ইত্যাদি নামীদামী ব্র্যান্ডের জন্ম যেমন জাপানে, তেমনই পৃথিবীর সর্বপ্রথম বুলেট ট্রেনের যাত্রাও সেই একই দেশের মাটিতে। ইলেকট্রনিক্সের বাজারে সুনাম থাকার জন্য জাপান শহরে উৎপাদিত হয় বিশাল পরিমাণে ই-বর্জ্য। এই ই-বর্জ্যই এখন জাপানবাসীদের মাথা ব্যথার মূল কারণ। সুতরাং এই টোকিও মেডেল প্রজেক্ট ২০২০র কাজ হবে উপযুক্ত ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এইসব ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মধ্যে থেকে সোনা, রুপো বা ব্রোঞ্জের মত ধাতু নিষ্কাশন করে আনা।

টোকিও অলিম্পিক ২০২০র মেডেল

টোকিও মেডেল প্রজেক্ট ২০২০র তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়, জাপানের কোনো নাগরিক যদি অব্যবহৃত বা খারাপ হয়ে যাওয়া মোবাইল, টিভি, ল্যাপটপ, ক্যামেরা, ওভেন, স্মার্ট ঘড়ি ইত্যাদি যেকোনো ধরনের ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি ফেলে দিতে চান, তাহলে সেগুলি ফেলে না দিয়ে নির্দিষ্ট পুরসভার কাছে যেন জমা করেন। জাপান শহরের ১৬২১ টি পুরসভার ৯০ শতাংশ মানুষ এই বিশাল কর্মযজ্ঞে যোগদান করেন। ২০১৯ এর মার্চ মাস পর্যন্ত খাতায় কলমে ৭৮,৯৮৫ টন ছোটো আকারের ইলেকট্রনিক যন্ত্র জমা পড়ে, যার মধ্যে আবার ৬২ লক্ষ ব্যবহৃত মোবাইল ফোন জমা পড়ে জাপানের এনটিটি ডোকোমোর দোকানগুলিতে। এইসব ই-বর্জ্যের মধ্যে বিষাক্ত ক্ষতিকারক পদার্থের পাশাপাশি খুব অল্প পরিমাণ স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা, টিন, দস্তার মতো ধাতুও পাওয়া যায়। এই ধরনের ই-বর্জ্যকে সেই কারণে ‘আরবান মাইন’ বা ‘শহুরে খনি’ বলা হয়ে থাকে।

এরপর শুরু হয় সংগৃহীত ই-বর্জ্যগুলি থেকে ধাতু নিষ্কাশন ও পরিশোধনের কাজ। যে ৭৮,৯৮৫ টন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির কথা বললাম সেখান থেকে প্রায় ৩২.৩ কেজি সোনা, ৩৫০০ কেজি রুপো এবং ২২০০ কেজি ব্রোঞ্জ উদ্ধার করা হয় (অবশ্যই জাপানের ‘Act on promotion of recycling of small waste electrical and electronic equipment’ মেনে)। তুলনা করে বললে, খনি খুঁড়ে প্রতি টন আকরিক থেকে যেখানে ৩-৪ গ্রাম সোনা পাওয়া যায়, সেখানে ১ টন মোবাইল ফোন থেকে পাওয়া যায় ৩৫০ গ্রাম সোনা।

ই-বর্জ্য থেকে ধাতু নিষ্কাশনের কাজ চলছে

ধাতু সংগ্রহের প্রাথমিক কাজ শেষ। এইবার শুরু মেডেল গঠনের প্রক্রিয়া। মেডেলের ডিজাইন কেমন হবে তার জন্য অলিম্পিক কমিটি জাপানে আয়োজন করে মেডেল ডিজাইনের প্রতিযোগিতা। প্রায় ৪০০ টি বিভিন্ন রকম মেডেলের ছাঁচের মধ্যে থেকে প্রথম হয় জুনিচি কাওয়ানিশির ডিজাইনটি।

মেডেলের পাশাপাশি মেডেলের রিবনেও অভিনবত্ব আনে জাপান। নীল-সাদা চেক প্রিন্টের সাথে জাপানের ঐতিহ্যবাহী কিমোনো পোশাকের স্তরবিন্যাস (কাসানে নো ইরোমে) মিলিয়ে তৈরি করা হল মেডেলের রিবন। এই রিবন পরোক্ষে জাপানের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের বিষয়টি তুলে ধরে। এই রিবন বানানোর সময় তা পলিয়েস্টার ফাইবার দিয়ে বানানো হয়েছে। পলিয়েস্টার ফাইবারের বিশেষত্ব হল কারখানায় এই ফাইবার বানানোর সময় তুলনামূলক কম কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ হয়। আধুনিক প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে এই রিবনে যোগ করা হয়েছে সিলিকন লাইনিং, যা স্পর্শ করা মাত্র বুঝিয়ে দেবে মেডেলটি কোন ধাতুতে গড়া।

পরিশেষে একটাই কথা, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে জাপান যেভাবে কাজে লাগিয়েছে, তা গোটা বিশ্বের কাছে শিক্ষণীয়। হিসেব করে দেখা গেছে পাঁচ হাজার মেডেল তৈরি করতে যে পরিমাণ ধাতুর প্রয়োজন ছিল, তার প্রায় ৭০% ধাতু শুধুমাত্র ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি থেকেই সংগ্রহ করা গেছে। অর্থাৎ এ কথা বলা যেতে পারে এবারের টোকিও অলিম্পিকে ভারতের ঝুলিতে যে ৭টি মেডেল এসেছে, তার অনেকাংশেই রয়েছে জাপানের দামি ইলেকট্রনিক্সের কণা!

তথ্যসূত্র:

২০২০-র টোকিও অলিম্পিক্সে পদক তৈরি হচ্ছে জঞ্জাল থেকে!, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৮
ই-বর্জ্য থেকেই তৈরি হচ্ছে টোকিও অলিম্পিকের পদক, সংবাদ প্রতিদিন, ৩১ অক্টোবর, ২০১৯