অনলাইন মাধ্যমের সবথেকে বড় সুবিধা হল এটি যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গায় বসে ক্লাস করার সুবিধে দেয়। আমাদের দেশে বহু মেধাবী পড়ুয়া রয়েছেন, যারা নিজের রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে বা অন্য দেশে পাড়ি দেন শুধুমাত্র সেখানকার কোনো বড়ো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবেন বলে। তাঁরা যদি বিনামূল্যে বা স্বল্প মূল্যে অনলাইন ক্লাসের সুবিধা পান, তাহলে তাঁদের সেখানে গিয়ে আলাদা করে টাকা খরচ করে হোস্টেলে থেকে ডিগ্রি নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। বরং এ কাজটা তাঁরা বাড়িতে বসেই করতে পারবেন। তাছাড়া অনলাইন ক্লাস করে যেটুকু সময় বেঁচে যায়, সেই সময়ে তাঁরা পড়াশোনার বাইরে অন্যান্য সৃজনশীল কাজ বা খেলাধুলো করার সুযোগও পেয়ে যান।
দ্বিতীয়ত, করোনা মোকাবিলায় যেধরণের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে, অর্থাৎ বারবার হাত ধোওয়া, বা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা – স্কুল কলেজে এগুলোর কোনোটাই মেনে চলা সম্ভব হবে না। তাছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে যতই ‘আনলক’ বা ‘বিধিনিষেধ’ শুরু হোক না কেন, গণপরিবহণে মানুষ কীভাবে যাতায়াত করছেন (বিশেষ করে অফিস টাইমে) সেই ছবিটা আমাদের সকলেরই চেনা। বর্তমানে আমাদের দেশে টিকাকরণ চালু হলেও দেশের খুব নগণ্য সংখ্যক মানুষ টিকার দুটি ডোজ সম্পূর্ণ করেছেন। এই পরিস্থিতিতে ছোটো ছোটো স্কুলছাত্র থেকে কলেজ-পড়ুয়া সকলেই যে আগের পরিস্থিতিতে যেতে অনীহা বোধ করবেন, তা আর আলাদা করে বলে দিতে হবে না।
আর তার থেকেও বড়ো কথা, গত তিন দশকে আমাদের দেশে IT বা Information Technology র ব্যবহার এতটাই বেড়েছে, যে বিশেষজ্ঞরা এই সময়টাকে Digital Movement বলে নামকরণ করেছেন। ফলে আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রেও IT র প্রয়োগ না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। আমাদের দেশের ইঞ্জিনিয়াররা যেভাবে নিত্যনতুন সফটওয়্যার বাজারে নিয়ে আসছেন, তাতে অনলাইন পঠনপাঠনের উপযোগী সফটওয়্যারের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। এইসব সফটওয়্যার এমনভাবে ডিজাইন করা থাকে যে জানার বিষয়গুলো বইয়ের ছাপার অক্ষর থেকে বেরিয়ে আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে। শুধু তাই নয়, এইসব কোর্সগুলো এমনভাবে সাজানো, যাতে কোনো একটি বিষয়ের ওপর শিক্ষাদানের পর সেই বিষয় নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকে। এই প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা সেই বিষয়ের ওপর নিজের দক্ষতা যাচাই করতে পারেন। কোনো প্রশ্নের উত্তরে ভুল হলে পরেরবার সেটা ঠিক করার সুযোগও মেলে এই নয়া ব্যবস্থায় (self checking and self evaluation)। এই বিষয়গুলির কোনো অংশ বুঝতে অসুবিধা হলে, কিংবা কোনো অংশে কোনো প্রশ্ন থাকলে ছাত্রছাত্রীরা সেই পাঠের কমেন্ট বক্সে অথবা ইমেইলের মাধ্যমে তা সহজেই জানিয়ে আসতে পারেন। সব মিলিয়ে এই ব্যবস্থায় ছাত্রছাত্রীরা সহজেই অল্প সময়ের মধ্যেই কোনো বিষয় আত্মস্থ করতে সক্ষম হন।
পড়াশোনার উপযোগী কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্মভারতবর্ষে যে কটি শাখায় পঠনপাঠন হয়, তার অনেকগুলোতেই (বিশেষত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শাখাগুলোতে) পরীক্ষাগার বা ল্যাবোরেটরির একটা বড়ো ভূমিকা আছে। বিজ্ঞানের যেকোনো বিষয়ে এই ল্যাবোরেটরিগুলোর উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়। আমরা পড়ার বইয়ে যেসব পরীক্ষার কথা জেনে বা শুনে আসছি সেগুলোই হাতে কলমে পরীক্ষা করে উপলব্ধি করা। এখন যদি কোনোভাবে অনলাইন ক্লাসে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ভার্চুয়াল ল্যাবোরেটরির প্রচলন করা যায়, তাহলে আমরা সেই সবকিছুই এক ছাদের তলায় করতে পারবো। ল্যাবোরেটরিতে মূল্যবান যন্ত্রপাতি বা বিক্রিয়কের খরচও কমবে, আবার ছাত্রছাত্রীরাও উন্নত উপায়ে পরীক্ষানিরীক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হবেন।
এগুলো ছাড়াও আরও ছোটো ছোটো কয়েকটি বিষয় থেকে যায়। যেমন শিক্ষাবিদরা শিক্ষাগ্রহণের পদ্ধতি অনুযায়ী ছাত্রদের দুভাগে ভাগ করেন। একদল যাঁরা অল্প সময়ের মধ্যেই অনেকটা পড়া বুঝে নিতে পারেন (fast learner), আর আরেক দল যাঁদের পড়া বুঝতে ও পড়া তৈরি করতে তুলনামূলক বেশি সময় লাগে (slow learner)। এখন ক্লাসে পড়াতে এসে কোনো শিক্ষকের পক্ষে slow learner এবং fast learner-দের শনাক্ত করা একপ্রকার অসম্ভবই বলা চলে। এর ফলে slow learner-রা ক্লাসের বাকিদের তুলনায় পিছিয়ে পড়তে থাকেন। সেই তুলনায় অনলাইন মাধ্যমে পড়াশোনার সুযোগ পেলে তাঁরা একটি ভিডিও প্রয়োজনে একাধিকবার দেখে তাঁদের সুবিধা অনুযায়ী পড়া তৈরি করতে পারেন।
শুনতে যতটা ভালো লাগছে ব্যাপারটা মোটেই সেরকম নয়। কিছু সমস্যা এখানে থেকেই যায়।
অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার সবথেকে বড়ো গাফিলতি হল, এর সব চিন্তাভাবনাই শহরাঞ্চলে আধুনিক মানুষদের কথা মাথায় রেখে। একটি মার্কিন প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতের মোট জনসংখ্যার কেবল ২৬% মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনরকম অসুবিধা ভোগ করেন না। এখন প্রশ্ন হল এই ২৬% এর বাইরে যে বিপুল সংখ্যক ভারতীয়দের আমরা বাদ দিলাম, অনলাইন শিক্ষা প্রবর্তিত হলে তাঁরা কোথায় যাবেন? এখনও বহু গ্রামেগঞ্জে ঠিকঠাকভাবে ইলেকট্রিক আলো পৌঁছায়নি। সেইসব মানুষদের হাতে হাতে স্মার্টফোন ঘুরবে এমনটা আমরা কীভাবে ধরে নিতে পারি?
আমাদের দেশে পাঠশালা বা টোলে পড়ানোটা যুগ যুগ ধরে একটা ঐতিহ্য বহন করে আনছে। গুরু ও ছাত্রের দৈহিক উপস্থিতিতেই এই ঐতিহ্যের সার্থকতা। আমাদের দেশে স্বামীজি, গান্ধীজি বা বিদ্যাসাগরের মত মহান ব্যক্তিরা যে শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এলেন, তাকে একপ্রকার বদলে দিয়ে এই নতুন ব্যবস্থা চালু করলেই তা সফল হবে কি? এ দেশের শিক্ষার্থীরাই বা কতটা গ্রহণ করতে পারবেন এই নতুন ব্যবস্থাকে? হার্ভার্ড, অক্সফোর্ডের মত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অনলাইন শিক্ষা জনপ্রিয় হয়েছে মানে আমরা কখনই এটা ধরে নিতে পারি না আমাদের দেশেও সেই একই ফল পাবো। আমাদের দেশের প্রযুক্তি ও পরিকাঠামো বিদেশের মত অত উন্নত মানের নয়, ফলে তাদের অনুকরণ করে অনলাইন শিক্ষা প্রচলন করা উচিত হবে না এ কথা আমাদের মানতে হবে।
অনলাইনে পড়াশোনা আবার মানুষকে কুঁড়ে করে দিতে পারে। দশটা পাঁচটার স্কুল কলেজে আমরা যেভাবে শারীরিক কসরত করি, অনলাইনে ঘরে বসে পড়াশোনায় তার সিকিভাগও করতে হয় না। আর যদি অনলাইনে পরীক্ষাব্যবস্থার কথাই বলেন, তাহলে সেখানে ছাত্রছাত্রীদের অসাধু উপায় অবলম্বন করার প্রবণতা থেকে যায়। সেক্ষেত্রে সঠিক মেধার মূল্যয়ন হয় না।
এছাড়াও অনলাইন পঠনপাঠনে যেহেতু দীর্ঘক্ষণ মোবাইল বা কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, তাই পরোক্ষে তা চোখের মারাত্মক ক্ষতি করে। গত বছরই তো একটি নামকরা অনলাইন মিটিং অ্যাপের বিরুদ্ধে তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার মত মারাত্মক অভিযোগ উঠেছিল। সেক্ষেত্রে আমার-আপনার মত সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে এই অ্যাপ ব্যবহার করা কতটা সুরক্ষিত সেই নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
তাহলে করণীয় কী?
দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় ঢালাও পরিবর্তন আনার চিন্তা না করে আমাদের করণীয় অনলাইন ও অফলাইন দুধরনের পঠনপাঠনকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষার পদ্ধতি বা মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হল শিক্ষার্থীর জ্ঞান সংগ্রহ। তাই সেই মর্মে যদি কোনো নতুন চিন্তাভাবনার প্রণয়ন করা হয় তাহলে তা সাদরে গ্রহণ করতে হবে। অনলাইন বনাম অফলাইন পড়াশোনা এইধরনের বিতর্কগুলি থেকে বেরিয়ে এসে দেশীয় প্রযুক্তি ও পরিকাঠামোর সদ্ব্যবহার করতে হবে।
অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করতে হলে সবার আগে তার একটা ভিত্তি স্থাপন করা খুব জরুরি। শিক্ষক এবং ছাত্রদের অনলাইন ট্রেনিংয়ের উপযুক্ত করতে তাদের নিয়মিত এই বিষয়গুলিতে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। মোবাইল বা কম্পিউটার স্ক্রিনের এপার ওপারে বসে থাকলেও শিক্ষক ও ছাত্রের মানসিক সৌহার্দ্যের সম্পর্ক যাতে অটুট থাকে তার বন্দোবস্ত করতে হবে। সময়ের সাথে সাথে একঘেয়ে সিলেবাস বর্জন করে তার পরিবর্তে আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে আকর্ষণীয় পাঠ সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এইধরনের নীতি প্রয়োগ করা শুরু করে দিয়েছেন এবং এতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের যথেষ্ট সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন IIT কলেজগুলি তো বটেই, তাছাড়াও অমৃতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রমুখ অনলাইন পঠনপাঠনের ওপর জোর দিচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গ জাতীয় আইনবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় (WBNUJS) অনলাইন মাধ্যমকে হাতিয়ার করে একটা গোটা শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষাও নিয়ে ফেলেছেন। কেন্দ্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড (CBSE) এর অনুপ্রেরণায় তৈরি হয়েছে OLab নামে একটি ভার্চুয়াল ল্যাবরেটরি, যা রীতিমত গোটা দেশে নজর কেড়েছে। কলকাতা বা যাদবপুরের মত প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দৌলতে ডিজিটাল লাইব্রেরির দরজাও খুলে গেছে সাধারণ মানুষের কাছে।
অনলাইন শিক্ষা প্রবর্তিত হলে তাকে জনপ্রিয় করতে সরকারেরও একটা বড়ো ভূমিকা থাকা উচিত। গরীব ঘরে ঘরে সাইকেল বা অনুদানের পরিবর্তে অ্যান্ড্রয়েড ফোন বা ট্যাবলেট পৌঁছে দিতে হবে। ইন্টারনেট পরিষেবায় ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে বিশেষ প্যাকেজ রাখতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ ছাড় দিতে হবে।
সবশেষে একটাই কথা, গোটা আলোচনায় একবারও বলা হয়নি সমগ্র শিক্ষার পরিকাঠামো বদলে তাকে পুরোটাই অনলাইন মাধ্যম করে দেওয়া হোক। অনলাইন শিক্ষা প্রথাগত শিক্ষার একটা বিকল্প হতে পারে, কিন্তু কখনই প্রথাগত শিক্ষা বাদ দিয়ে আমরা অনলাইন শিক্ষা চালু করতে পারি না। তবে হ্যাঁ, এখন আমরা যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি তাতে আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষাব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে গেলে অনলাইন মাধ্যমের দিকে আংশিক ঝুঁকতে হলেও হতে পারে। আমরা সত্যিই জানি না ভবিষ্যতে আরও কোন ভয়ানক বিপদ আমাদের সামনে অপেক্ষা করে আছে। সম্প্রতি কোনো কোনো সংস্থার তরফে দাবি করা হচ্ছে ভারতে নাকি তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। আর বিধিনিষেধ না মানলে দ্বিতীয় ঢেউয়ের তুলনায় মারাত্মক হতে পারে তৃতীয় ঢেউ। ডেল্টার সাথে সাথে ডেল্টা প্লাস, কাপ্পা, মিউ ইত্যাদি বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের খবর প্রকাশ্যে আসতে ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে physical এবং digital দুয়ে মিলে phygital– এরকম একটি ধারণা নিয়েই আগামী কয়েক বছর চলতে হতে পারে আমাদের। সেদিক থেকে বিচার করলে ভবিষ্যতের শিক্ষাব্যবস্থায় যে একপ্রকার paradigm shift আসতে চলেছে একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে।


1 মন্তব্যসমূহ
খুব সুন্দর ও যুক্তিযুক্ত উপস্থাপনা
উত্তরমুছুন