ট্রিসকাইডেকাফোবিয়া! ১৩ সংখ্যাটিকে ‘অশুভ’ বলে গণ্য করার ভীতিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই নামে ডাকা হয়। পশ্চিমী জগতের মোটামুটি সব দেশেই ১৩ কে অশুভ নামে ডাকা হয়ে থাকে। ১৩-র প্রতি এই ভীতি বা কুসংস্কার এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে আজও বহু হাসপাতালে ১৩ নম্বর বেড ফাঁকা থাকে; কিছু কিছু হাসপাতাল তো ১৩ নম্বর বেডটাই তুলে দিয়ে ১২, ১২এ, ১৪ হিসেবে বেডের নামকরণ করেছে। বহুতল বিল্ডিংয়ে ১৩ তলার ফ্ল্যাট বা ১৩ নম্বর রুমটি এখনও অনেকে কিনতে চান না; এমনকি কোনো দ্রব্যের বিক্রয়মূল্যতেও ১৩ সংখ্যাটি থাকলে তাকে কমিয়ে-বাড়িয়ে ১২ বা ১৪ করে দেওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। অর্থাৎ এককথায় ১৩-র সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত যেকোনো বিষয়কেই অমঙ্গলজনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভুলে গেলে চলবে না ১৩-র প্রতি এই ভীতির পেছনে বহু বছর ধরে চলে আসা নানা ধরনের উক্তি, মতবাদ, বাইবেলের বর্ণনা, কুসংস্কার ইত্যাদিও জড়িয়ে রয়েছে।


১৩ নিয়ে এই ভ্রান্ত ধারণার কথা বলতে হলেই প্রথমেই বলতে হয় যিশুখ্রিস্টের ‘লাস্ট সাপার’-এর কথা। লাস্ট সাপারের রাতে ডিনার টেবিলে ১৩ জন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। কথিত আছে লাস্ট সাপার গ্রহণ করা হয়েছিল নিসান মাসের (ইহুদী ক্যালেন্ডারের একটি মাস) ১৩ তারিখে। জুডাস ইসকারিওট নামের এক ব্যক্তি যিশুর সঙ্গে খাবার টেবিলে প্রতারণা করেন। তিনি নাকি ঐদিন ত্রয়োদশতম ব্যক্তি হিসেবে ডিনারে যোগ দিয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন যিশুকে ক্রুসবিদ্ধকরণের তারিখটি ছিল ১৩ই নিসান। বাইবেলে ১৩ নিয়ে বলা বেশিরভাগ তথ্যই কোনো না কোনো দিক থেকে অশুভ সংকেত বহন করে।
যিশুখ্রিস্টের ‘লাস্ট সাপার’

কোনো মাসের ১৩ তারিখ যদি শুক্রবার হয় তবে ইউরোপের মানুষজন সেই দিনটিকে অশুভ বলে মনে করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীতে নানা ধরনের যেসব বিপর্যয় এসেছে, তার অনেকগুলোই ১৩ তারিখের শুক্রবারে। তাছাড়া যিশুকে যে দিন ক্রুসবিদ্ধ করা হয়, অনেকের মতে সেই দিন ছিল ১৩ তারিখের শুক্রবার। এমনও বলা হয় কোনো মাসের ১৩ তারিখ যদি শুক্রবার হয়, তবে ওইদিন চুল কাটা, কোনো সমাধির পাশ দিয়ে হাঁটা, বা মইয়ের নীচ দিয়ে হাঁটা– এই সবকিছুই অমঙ্গলজনক। হোলি গ্রেইল রক্ষাকারী নাইটস টেম্পলারে তাই প্রত্যেক শুক্রবারে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হত। ইউরোপের একটি সমীক্ষায় এও দেখা গেছে যে ১৪ তারিখে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোতে অন্যান্যদিনের তুলনায় বেশি বিপদ আপদের খবর প্রকাশিত হয়।

ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালে বোঝা যাবে ১ বছরকে ১২ টি মাসে বিভক্ত করা হয়েছে এবং ১ দিনকে ১২ ঘন্টা + ১২ ঘন্টা সময়ে ভাগ করা হয়েছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ১৩ একটি অবিভাজ্য সংখ্যা, যাকে দুটি সংখ্যার অনুপাত হিসেবে প্রকাশ করা যায় না। তাই সেই থেকে গণিতে ১৩ সংখ্যাটি খুব একটা দরকারি সংখ্যা বলে গণ্য করা হয় না।

আগেকার দিনে ফাঁসির মঞ্চ যেভাবে তৈরি করা হত তাতে ফাঁসিকাঠে ওঠার সিঁড়িতে ১৩ টি ধাপ থাকতো। তাছাড়া মঞ্চে উঠে ১৩ পা এগিয়ে আসামিকে ফাঁসিকাঠ অবধি যেতে হত।

স্ক্যান্ডেভিয়া ভাইকিং যোদ্ধাদের অপদেবতার নাম ছিল লোকি। বাইবেলের মতে এই লোকি ছিলেন ত্রয়োদশতম দেবতা। নর্স পুরাণে বর্ণিত আছে, এক ডিনার পার্টি বানচাল করে দেন এই অশুভ দেবতা লোকি। তার আগমনে সমস্ত আয়োজন ভেস্তে যায় এবং গোটা পৃথিবী অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। 

ভাগ্য গণনার জন্য বহু বছর আগে একধরনের ট্যারট কার্ড ব্যবহার করা হত। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী এই কার্ডকে অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবে ভাবা হত। এই কার্ডের এক একটি সেটে ৭৮ টি করে কার্ড থাকতো। এই ৭৮ টি কার্ডের মধ্যে ১৩ নম্বর কার্ডটি ছিল মৃত্যুর।

১৩ নম্বর ট্যারট কার্ডে মৃত্যুর প্রতীক

বিশ্ব জুড়ে যে কজন কুখ্যাত খুনির নাম আমাদের জানা, কাকতালীয়ভাবে তাদের প্রত্যেকেরই ইংরেজি নাম ১৩ অক্ষরের। যেমন ধরা যাক চার্লস ম্যানসন (Charles Manson), বা জ্যাক দ্য রিপার (Jack the Ripper), অথবা জেফরি দামের (Jeffrey Dahmer), থেডর বানডি (Theodore Bundy), আলবার্ট ডি স্যালভো (Albert De Salvo)– সকলেরই নাম ১৩ অক্ষরের।

নাসার ‘অ্যাপোলো’ নভোযানের কথা আমাদের সকলের জানা। অ্যাপোলো নভোযানটি যেদিন ধ্বংস হয় সেটি ছিল ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসের ৪ তারিখ (৪/১১/৭০)। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে ৪+১+১+৭+০ = ১৩।

কাকতালীয়ভাবেই হোক, বা কোনো কারণবশতই হোক, বিশ্বের বিভিন্ন অশুভ ঘটনার সঙ্গে ১৩ সংখ্যাটির যোগাযোগ থাকাতে অনেকের মনে সেই থেকেই ১৩ সংখ্যাটি অমঙ্গলের প্রতীক হিসেবে থেকে গেছে। তবে ১৩ সংখ্যাটি শুধুই যে অপয়া বা অশুভ তাই নয়। ভারতীয় সংখ্যাতত্ত্ব দেখলে বোঝা যাবে সেখানে এই সংখ্যাটিকে ‘মহাজাগতিক সংখ্যা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যে কোনো মাসের ১৩ তারিখকে তন্ত্র ও অন্যান্য হিন্দু ধারা ‘পবিত্র’ বলে মনে করে। এই দিনগুলোতে বিশেষ পূজা-পাঠের নির্দেশ অনেক শাস্ত্রেই রয়েছে। মাঘ মাসের ১৩ তারিখেই মহাশিবরাত্রি উদযাপিত হয়। হিন্দু ঐতিহ্য মতে এই দিনটি বছরের পবিত্র দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম। এছাড়া হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে ত্রয়োদশী দিনটি শিবের প্রতি উৎসর্গীকৃত।

তাই আমার মনে হয় ‘আনলাকি থার্টিন’-এর মিথকে ভুলে ১৩ সংখ্যাটিকে সকলের স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করা উচিত। ‘লাকি’-‘আনলাকি’-র উর্ধ্বে গিয়ে হয়ত এই সংখ্যাটিই হয়ে উঠতে পারে আপনার জীবনের সফলতার সংখ্যা।

তথ্যসূত্র: