যেথাইল্যান্ডের কথা বলছি তা আজকের দিনের কোনো আধুনিকমনস্ক পরিণত দেশ নয়। সময়টা তখন ১৮৮০ সাল। ইউরোপ ও তার অন্যান্য উপনিবেশে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও ইউরোপ থেকে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই দেশে তখনও ঘনিয়ে আছে মধ্যযুগীয় অন্ধকার।
থাইল্যান্ডের নাম তখন শ্যাম প্রদেশ। সেই শ্যাম প্রদেশের তৎকালীন রাজা চতুর্থ রামের কোল আলো করে ১৮৬০ সালে জন্মগ্রহণ করেন তাঁর কন্যা সুনন্দা কুমারীরত্ন। এই সুনন্দা কুমারীরত্নের যখন ১৬ বছর বয়স, রাজপরিবারের রীতি মেনে তাঁর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তাঁরই দুঃসম্পর্কের আত্মীয় চুলালংকর্ণ বা পঞ্চম রাম। চুলালংকর্ণ ঠিক কতগুলি বিবাহ করেছিলেন তা সঠিক জানা যায় না। তবে সেই সময় লোকমুখে প্রচলিত ছিল চুলালংকর্ণের ৮৪ টি সন্তান ছিল। এর মধ্যে সুনন্দার গর্ভে একটিমাত্র কন্যাসন্তানের জন্ম হয় ১৮৭৮ সালে।
১৮৮০ সালের মে মাস নাগাদ একবার সুনন্দা নৌকো করে সপরিবারে রাজার গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ ব্যাং পাইনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। সেই সময় শ্যাম প্রদেশের প্রত্যেক রানিই নিজের নিজের আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় আনন্দ উদযাপন করতেন। রাজপরিবারের নিয়ম অনুযায়ী রাজ্যের সবথেকে ভালো ও পোক্ত নৌকোগুলি রাজা-রানি ও তাঁর আত্মীয়স্বজনদের ব্যবহারের জন্য রাখা থাকত, যাতে জলপথে চলাকালীন তাঁরা কোনোরকম অসুবিধায় না পড়েন। যাইহোক, সুনন্দা কুমারীরত্ন তখন সন্তানসম্ভবা। রাজপরিবারের সেই বজরার একটি নৌকোয় ছিলেন সুনন্দা ও তাঁর দেড় বছরের কন্যা কানাভর্ন বেজারত্ন। সঙ্গে রাজপরিবারের কিছু নিরাপত্তারক্ষী।
মে মাসের দুপুরে রানির নৌকো তখন চাও ফ্রায়া নদী অতিক্রম করছে। এই চাও ফ্রায়া নদীকে থাইল্যান্ডের অন্যতম দীর্ঘ ও বৃহৎ নদীগুলির তালিকায় রাখা হয়। এই নদীর জলস্রোত এতই তীব্র ও ভয়ঙ্কর যে, জাহাজ চালনায় পারদর্শী অনেক নাবিকই এই পথকে এড়িয়ে চলতেন। তবুও রাজা-মহারাজাদের খেয়াল! তাই রানির নৌকো চালানোর জন্য চাও ফ্রায়ার জলপথকেই বেছে নেওয়া হল।
সুনন্দা কুমারীরত্ন ও তাঁর কন্যা কানাভর্ন বেজারত্ননৌকো যখন নদীর মাঝপথে তখন হঠাৎই ঘটল এক দুর্ঘটনা। নদীর বুকে একটা বড়ো ঢেউ এসে নৌকোয় ধাক্কা মারতেই টাল সামলাতে না পেরে নৌকো উল্টে জলের মধ্যে পড়ে গেলেন রানি সুনন্দা ও তাঁর দেড় বছরের কন্যা। পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু লোকজন হইহই করে উঠলো।
রানি সুনন্দা ও তাঁর কন্যা কেউই সাঁতার জানতো না। এদিকে সেই সময় শ্যাম প্রদেশে প্রচলিত ছিল এক অদ্ভুত নিয়ম। রাজা-রানি ও তাঁদের সন্তানদের স্পর্শ করার অধিকার তাঁদের সমকক্ষ রাজপরিবারের সদস্যদের ছাড়া আর কারও ছিল না। এই নিয়মের গেরোয় নিরাপত্তারক্ষী অথবা সাধারণ জনতা কেউই রানিকে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে এলেন না। সেইদিন, ১৮৮০ সালের ৩১ মে, শ্যামবাসী শুনেছিল এক ডুবন্ত অসহায় নারীর প্রাণ বাঁচানোর কাতর আর্তি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শেষ অবধি নিয়ম ভেঙে কেউই তাঁদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। চাও ফ্রায়া নদীতেই সলিল সমাধি হয় জলজ্যান্ত দুটি প্রাণের। নৌকোয় থাকা বাকিরা অবশ্য স্থানীয়দের সাহায্যে প্রাণে বেঁচে যান।
সন্তানসম্ভবা রানি ও তাঁর কন্যার মৃত্যুর খবর রাজবাড়িতে পৌঁছতেই তৎক্ষণাৎ রাজা পঞ্চম রাম ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছান। ঘটনার বিবরণ শুনে পঞ্চম রাম নিরাপত্তারক্ষীদের এহেন কাজে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দেশে এরকম আইন প্রচলন থাকলেও কীভাবে তারা মহারানিকে ডুবতে দেখেও তাঁকে কোনোরকম সাহায্য করলেন না! আইনকানুন, নিয়ম-নীতির উর্ধ্বে গিয়ে এ ছিল এক মানবিকতার প্রশ্ন। এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য শ্যাম প্রদেশের অদ্ভুত আইনকে ঘিরে অসন্তোষ প্রকাশ করেন রাজার ছেলেরাও। শেষ অবধি রানির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সকল কর্মীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়।
রানি সুনন্দার মৃত্যু যেমন এক মর্মান্তিক ঘটনা, তেমনই তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব ব্যয়বহুল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কথা শোনা যায় তার মধ্যে অন্যতম ছিল উনিশ শতকের থাইল্যান্ডের রানি সুনন্দার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। রানির মরদেহকে কফিনে রেখে প্রথমে তরল রুপো ভরে দেওয়া হয় তাঁর শরীরে। তারপর সোনা দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয় তাঁর শরীর। খরচ পড়ে তখনকার দিনে কয়েক কোটি টাকা। এবং তার সাথে রাজা পঞ্চম রামের নির্দেশে গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ ব্যাং পাইনের পেছনের বাগানে নিজের স্ত্রী ও সন্তানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি মূর্তি ও একটি সমাধিসৌধ স্থাপন করেন।
রানির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কাজ চলছেতথ্যসূত্র:





1 মন্তব্যসমূহ
সত্যিই!! কী দুর্ভাগ্য
উত্তরমুছুন