পা
গ্রিক কাহিনি অনুযায়ী প্যাঁচা হল দেবী এথেনার প্রতীক। এই এথেনা দেবী সেদেশে অনেকটা মা সরস্বতীর মত জ্ঞানের দেবী হিসেবে পূজিতা হন। প্যাঁচা যেহেতু অন্ধকারেও দেখতে পায়, তাই তার দৃষ্টিকে অন্ধকারভেদী দিব্যচক্ষুর সঙ্গে তুলনা করা হয়। অর্থাৎ এককথায় মানবমনের নিকষ কালো অন্ধকারে একছটাক শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করে এই প্যাঁচা।
প্রাচীন মিশরের হায়ারোগ্লিফিক লিপিতেও এই প্রাণির ব্যবহার দেখা যায়। রোমান হরফে যেটি M সেটিকে প্যাঁচার ছবি দিয়ে প্রকাশ করা হত হায়রোগ্লিফিকে। এছাড়া মিশরে শোক ও দুঃখের প্রতীক ছিল প্যাঁচা।মিশরে সমস্ত চিত্রই দেখা যায় মুখের একপাশের, ব্যতিক্রম কেবল প্যাঁচা। প্যাঁচার ছবি আঁকার সময় শরীরের অংশ পাশের দিকে ফিরিয়ে আঁকা হলেও মুখটি থাকত সামনে ফিরে।
রোমানদের বিশ্বাস ছিল প্যাঁচার ডাক শোনা মানে মৃত্যুর পদধ্বনি শোনা। জুলিয়াস সিজার থেকে অগাস্টাস– অনেকের মৃত্যুর বার্তাই নাকি বয়ে এনেছিল প্যাঁচা। ব্যবসায়ীরা যদি বেরোনোর আগে প্যাঁচার দেখা পেতেন তখন হয় তাঁদের জাহাজডুবি ঘটত, না হয় তারা পড়ত ডাকাতের খপ্পরে। সেই থেকে রোমে প্যাঁচার দেখা পাওয়া ছিল অযাত্রার প্রতীক।
গ্রিক দেবী এথেনা ও প্যাঁচাএবার আসি হিন্দুদের পৌরাণিক কাহিনিতে। হিন্দুধর্ম অনুযায়ী লক্ষ্মী হলেন শ্রী বা সুরুচি এবং সম্পদের দেবী। এহেন দেবীর বাহনস্বরূপ প্যাঁচাকে বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে তিনটে ঘটনার উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
প্রথমত, অনেকে মনে করেন এই ঘটনার সঙ্গে দুর্বাসা মুনির যোগসূত্র রয়েছে। একবার দুর্বাসা মুনির ভ্রমণকালে অপ্সরা রম্ভা তাঁকে ‘সন্তানক’ নামক একটি পুষ্পমাল্য উপহার দেন। রম্ভার দেওয়া সেই মালাটি দুর্বাসা মুনি দেবরাজ ইন্দ্রকে উপহার হিসেবে দেন। ইন্দ্র সেই মালা তাঁর হাতি ঐরাবতের মাথায় স্থাপন করলে, ঐরাবত মালাটি ছিন্ন করে মাটিতে নিক্ষেপ করে। এই ঘটনা দেখে দুর্বাসা ক্ষুব্ধ হয়ে, ইন্দ্রকে শ্রীভ্রষ্টের অভিশাপ দেন। তার এই অভিশাপের ফলে ত্রিপুরাসুরের কাছে পরাজিত হয়ে শ্রীহীন হয়েছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র। এই অভিশাপবাণীর ফলে মা লক্ষ্মী দেবরাজ ইন্দ্রের দেবলোক পরিত্যাগ করে পাতাল লোকে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করলেন। পরবর্তীকালে শ্রীবিষ্ণুর পরামর্শে যখন সমুদ্র মন্থন করে উত্তোলন করা হয় অমৃতকলস, তারই সাথে পুনরায় উত্থিত হন দেবী লক্ষ্মী, পরে যিনি দেবতা বিষ্ণুর বাহুলগ্না হন।
এই লক্ষ্মীদেবীকে বলা হয় ‘চঞ্চলা’, অর্থাৎ এক জায়গায় তিনি বেশিক্ষণ স্থায়ীভাবে থাকতে পারেন না। স্বাভাবিকভাবেই চঞ্চলা দেবী কোনো বাহনই স্থায়ীভাবে নিজের দখলে রাখতে পারেন নি। শেষমেষ একপ্রকার বাধ্য হয়েই তিনি প্যাঁচার মত ছোটোখাটো, শান্ত একটি জীবকে বাহন হিসেবে গ্রহণ করেন।
দ্বিতীয় আরেকদল ব্যক্তি মনে করেন বাহন হিসেবে প্যাঁচার নির্বাচন যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। আর এই যুক্তির পেছনে রয়েছে ধানের অবদান। ধান বাঙালির কাছে লক্ষ্মীসম। কিন্তু এই ধান খেয়ে ফেলে ইঁদুরে। ধানের গোলায় ইঁদুর ঢুকে নষ্ট করে বহু খাদ্যশস্য। আর এই ইঁদুরকে খায় প্যাঁচা। অর্থাৎ উল্টোদিক দিয়ে ভাবতে গেলে ধানকে ইঁদুরের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র প্যাঁচা। তাই লক্ষ্মীদেবীর বাহনস্বরূপ এই রাতজাগা পাখির আবির্ভাব।
শ্রী বিষ্ণু ও লক্ষ্মীদেবীআর তৃতীয় ও সর্বশেষ মতবাদ যেটি, সেটিই বলা ভালো সবথেকে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য। হিন্দুধর্মে বলা হয়েছে, যিনি জাগতিক মায়া-মোহ উপেক্ষা করে সাধনার ব্রত নিয়ে নির্জনে সেবাকাজে আত্মোৎসর্গে ব্রতী হবেন তিনি লক্ষ্মীদেবীর কৃপাদৃষ্টি লাভ করবেন। অর্থাৎ দেবীর বাহন সেই হতে পারবে, যে মা লক্ষ্মীর অবিশ্যিক গুণ যেমন তপস্যা, ক্ষমা, সেবাভাব, প্রেম, তিতিক্ষা, পবিত্রতা ইত্যাদি অর্জন করতে পারবে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে পেচক দিনে ঘুমায়, রাতে জেগে থাকে। নিদ্রা ও জাগরণ দিয়ে সে পরমার্থকামী সাধক-সাধিকাদের অনুকরণের যোগ্য। আবার ঋগ্বেদে বলা হয়েছে, পেঁচা আসলে যমের দূত। যমদূত পেচক তাঁর নিজের বৃত্তি ও প্রভুর দৌত্যের কথা স্মরণ করিয়ে মৃত্যুচিন্তা ও আত্মচিন্তা জাগ্রত করে সাধকের মনে। একই সঙ্গে ধনের উপার্জন ও ঐশ্বরিক চিন্তা– দুই গুণই পেচকের মধ্যে বিদ্যমান।
এ নিয়ে উত্তর ভারতের গো-বলয়ে আবার একটি লোকগাথা প্রচলিত রয়েছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ও দেবতাদের উত্থানের পর মর্ত্যলোকের পশুপাখিরা দেবদেবীদের জানায় তারা নিজেদের জীবন দেবদেবীদের বাহন হিসেবে অর্পণ করতে চায়। সেইমত সব দেবদেবীরা যেন নিজেদের পছন্দসই বাহন বেছে নেন। বাহন বেছে নেওয়ার এই অনুষ্ঠানে দেবী লক্ষ্মী এসেছিলেন সবার শেষে। তিনি বলেন এবার থেকে তিনি প্রতি কার্তিক অমাবস্যায় পৃথিবীতে আসবেন। পরবর্তী কার্তিক অমাবস্যার রাতে যে প্রাণী তাঁর কাছে আগে পৌঁছতে পারবে, তিনি তাঁকেই বাহন হিসেবে গ্রহণ করবেন।
দেখতে দেখতে চলে আসে সেই বহু প্রতীক্ষিত কার্তিক অমাবস্যার রাত। রাত বাড়তে থাকে, অথচ লক্ষ্মীদেবীর দেখা নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর লক্ষ্মীদেবী পৃথিবীতে পদার্পণ করেন। আর ততক্ষণে তাঁর প্রতীক্ষায় রাত জেগে ক্লান্ত হয়ে সমস্ত পশুপাখিই ঢলে পড়েছে ঘুমের কোলে। একমাত্র জেগে ছিল প্যাঁচা ও অন্যান্য কিছু নিশাচর প্রাণী। রাতের অন্ধকারে প্যাঁচার দৃষ্টিশক্তি হয়ে ওঠে প্রখর। তাই দূর থেকে দেবীকে আসতে দেখে সবার আগে প্যাঁচা উড়ে গিয়ে বসে তাঁর পায়ের কাছে। আর সেই থেকে মা লক্ষ্মী প্যাঁচাকেই নিজের বাহনের মর্যাদা দেন। তাই এখনও কোজাগরীর রাতে মা লক্ষ্মী প্যাঁচার সঙ্গে বেরিয়ে খোঁজ নেন কে কে জাগ্রত রয়েছে। জেগে থাকা ব্যক্তিকেই তিনি ধনের সন্ধান দেন।
তথ্যসূত্র:
4 মন্তব্যসমূহ
🦉
উত্তরমুছুনভালো লাগলো ❤️
উত্তরমুছুনবাহ্ খুব সুন্দর
উত্তরমুছুনScientific name ta jene gelum😀
উত্তরমুছুন