‘আমি মা বলে যত ডেকেছি, সে ডাক নূপুর হয়েছে ওই রাঙা পায়ে’ অথবা ‘আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে, কে দিয়েছে গালি’– তাঁর লেখা শ্যামাসঙ্গীতের ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে শ্যামা মায়ের প্রতি তাঁর সম্পর্কের কথা। শ্যামা কোথাও কোথাও তাঁর জন্মদাত্রী মায়ের মতই আদরণীয়, আবার কোথাও কোথাও নিজের ঘরের মেয়ের মতই অভিমানী-চঞ্চলা। তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ‘জাতের নামে বজ্জাতি’-কে তিনি কোনোদিনই পছন্দ করতেন না। তাঁর লেখা শ্যামাসঙ্গীতের ভক্তিরসে আজও মজে আপামর বাঙালি।

বিশিষ্ট বিপ্লবী ও নদিয়ার তৎকালীন লেজিসলেটিভ কাউন্সিল সদস্য হেমন্ত সরকারের অনুরোধে ১৯২৬ সালে নজরুল ইসলাম সপরিবারে হুগলি থেকে কৃষ্ণনগরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। সে সময়ে হেমন্তবাবুর কৃষ্ণনগরের বাড়িটি ছিল গোলাপটির চন্দ্রনাথ ঘোষ লেনে। যে সময়ের কথা বলছি, তখন বাংলায় ম্যালেরিয়া প্রাদুর্ভাবে আতঙ্কিত আট থেকে আশি। বাদ যাননি বিদ্রোহী কবিও। অনেকের মতে সেই সময় কিছুটা আর্থিক সঙ্কটেও ভুগছিলেন তিনি। এরকম একটা সময়ে কৃষ্ণনগরে নজরুলের আগমন, আর সেখানে থাকার সময়েই ওই বছর হেমন্তবাবুর বাড়িতে কালীপুজো করেন তিনি।

নজরুল এই কালীপুজো করিয়েছিলেন লালগোলার যোগাচার্য বরদাচরণ মজুমদারকে দিয়ে। পুজোয় ভোগ হিসেবে মাকে লুচি-ফুলকপি, বেগুন ভাজা নিবেদন করা হয়েছিল। পংক্তিভোজনে সেই সময়ের স্বদেশী ভাবনার বিশিষ্ট মানুষেরা প্রসাদ পেয়েছিলেন। যার মধ্যে তখনকার দুই প্রাক্তন মন্ত্রী তথা দুই বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী স্মরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন।

কাজী নজরুল ইসলাম

এবার একটু বরদাচরণ মজুমদার সম্পর্কে দু’কথা জেনে নেওয়া যাক। বরদাচরণের আদি নিবাস ছিল কাঞ্চনতলা গ্রামে। পেশা বলতে সে সময় তিনি ছিলেন লালগোলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। তবে নিজেকে তিনি পরিচয় দিতেন গৃহীযোগী হিসেবে। তাঁর যোগশক্তির কথা তখন জনাকয়েক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বরদাচরণ মাঝে মাঝে কলকাতায় গিয়ে ভবানীপুরের মোহিনী মোহন রোডে থাকতেন। সে সময় নজরুল ও আরও অনেকে বরদাচরণের কাছে যেতেন। বরদাচরণও বেশ কয়েকবার গিয়েছেন কবি নজরুলের ভাড়া বাড়িতে। এইভাবে বরদাচরণ ও নজরুল ইসলাম দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে এক আত্মিক সর্ম্পক।

নজরুল ছিলেন ভক্তিবাদী। পুজোর বাহ্যিক আড়ম্বরে তাঁর বিশ্বাস ছিল না। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একক সত্যকে তিনি উপলব্ধি করতে চেয়েছিলেন, যা ছিল সবরকম ভেদাভেদের ঊর্দ্ধে। তিনি জন্মসূত্রে ছিলেন মুসলিম। তবুও হিন্দুদের সঙ্গে তিনি অন্তরঙ্গভাবে মিশেছেন ছোটোবেলা থেকেই। নজরুলের স্ত্রী প্রমীলা দেবী ছিলেন একজন হিন্দু (যদিও, প্রমীলা দেবীকে অনেকেই হিন্দু বলে মানতে চান না। তিনি ব্রাহ্ম সমাজের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যাকে বর্তমানে একটি আলাদা ধর্ম হিসেবেই দেখা হয়)।

নিজের সন্তানদের নামকরণ প্রসঙ্গেও নজরুলের এই গুণটির কথা বারবার উঠে এসেছে। তাঁর চার সন্তানের মধ্যে তিনি প্রথম ও দ্বিতীয় সন্তানের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মহম্মদ ও অরিন্দম খালেদ; আর বাকি দুজনের নাম ছিল সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধ। নজরুল নিজে যেমন আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় রীতিনীতির পরিবর্তে মানবধর্মকে প্রাধান্য দিতেন, তেমনি তিনি নিজের সন্তানদেরও কোনোরকম ধর্মীয় শিক্ষার পাঠ দেননি। তবে এই ঘটনা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। অনেকে মনে করেন দ্বিতীয় পুত্র মারা যাওয়ার পর শোকে যখন প্রায় উন্মাদ অবস্থা তাঁর, সেই সময় তিনি কিছুটা হলেও ধর্মের দিকে ঝুঁকেছিলেন। স্ত্রী প্রমীলা দেবীর মৃত্যুর পর ধর্মের প্রতি তাঁর বিশ্বাস আরো কিছুটা বৃদ্ধি পায়। নজরুলের সেই পুরোনো বন্ধু বরদাচরণের অনুরোধে তিনি ছেলের মৃত্যুর পর প্রথম কালীপুজো করেছিলেন।

নিশেষভূষণ স্যানাল, বরদাচরণ মজুমদার ও কাজী নজরুল ইসলাম

শুধু নিজের বাড়িতেই নয়, সময় পেলেই তিনি চলে আসতেন বীরভূমের তারাপীঠে। নজরুল যখন ১৯১৬ সালে প্রথম তারাপীঠ দর্শন করেন তখন তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর। নজরুল নিজের গ্রামের অনেকের মুখেই শুনেছিলেন সাধক বামাখ্যাপার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নজরুল যখন প্রথম তারাপীঠে পা রাখেন তার বছর পাঁচেক আগেই দেহত্যাগ করেছিলেন বামাখ্যাপা। ফলে সামনাসামনি কোনোদিনও নজরুল আর বামাখ্যাপার সাক্ষাৎ হয়নি। যাইহোক, তার পর থেকে জঙ্গলে ঘেরা পথ ঠেলে শুধুমাত্র শ্রদ্ধা আর ভক্তির টানে তিনি মাঝেমধ্যেই (১৯১৬ থেকে ১৯৩৮ সাল অবধি) পৌঁছে যেতেন তারামায়ের মন্দিরে। ইসলাম পরিবারে জন্ম হলেও তিনি সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে কতটা অমান্য করতেন তা এহেন ঘটনা থেকেই প্রমাণ করা যায়। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী এও বলেছেন যে এই তারাপীঠ মহাশ্মশানে বসেই নজরুল তাঁর অনেকগুলি শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেছেন; যার মধ্যে অন্যতম– “ভারত শ্মশান হল মা তুই শ্মশানবাসিনী বলে”।

নজরুলের বিভিন্ন সমন্বয়পন্থী উদ্যোগকে মৌলবাদীরা আঘাত করেছে বারবার। কট্টর মুসলমানদের কাছে তাঁর পরিচয় হয় কাফের হিসেবে। পূর্ববঙ্গের রেডিওগুলি এক সময় নজরুলের শ্যামাসঙ্গীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এত কিছুর পরেও নজরুলকে যে নিজের আদর্শ থেকে টলানো যায়নি, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর একটি লেখা থেকে– “বাংলার মুসলমান সমাজ ধনে কাঙাল কিনা জানি নে, কিন্তু মনে যে কাঙাল এবং অতি মাত্রায় কাঙাল, তা আমি বেদনার সঙ্গে অনুভব করে আসছি বহুদিন হতে। আমায় মুসলমান সমাজ কাফের খেতাবের যে শিরোপা দিয়েছে তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করেছি। ...তবে আমার লজ্জা হয়েছে এই ভেবে, কাফের আখ্যায় বিভূষিত হওয়ার মত বড় তো আমি হইনি।”

তথ্যসূত্র:

কাজী নজরুল ইসলামের কালী পুজো, এই সময়, ২৭ অক্টোবর, ২০১৯
সাধক বামাখ্যাপা, শিবশংকর ভারতী, শারদীয়া বর্তমান ১৪২৮
Yogi Baroda Charan Majumdar