বাঙালিদের উৎসব মরশুমের একটা বড় সময় অতিক্রান্ত। দুর্গাপুজো, কালীপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো অতিক্রম করে অনেকেই আবার ফিরে গেছেন পুরোনো রুটিনে। সামনে আবার আসছে বড়দিন, নিউ ইয়ারের জাঁকজমক। এই উৎসবের দিনগুলিতে দেশের সর্বত্র যে ছবিটা প্রায় প্রতিবছর একইরকম থেকে যায় তা হল ‘আলো’-র রোশনাই। পুজোর দিন মানেই রাজপথ থেকে অলিগলি সেজে ওঠে রংবেরঙের আলোর মালায়। উৎসবের আমেজে মুখরিত জনগণ উৎসাহভরে চেয়ে থাকে সেই প্রজ্জ্বলিত আলোকবিন্দুর দিকে। তবে এই সব কিছুর অলক্ষ্যে যে জিনিসটা রয়ে যায় তা হল এইসব কৃত্রিম আলোর ব্যবহারে পরিবেশে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে ‘আলোক দূষণ’।

কোনো স্থানে প্রাকৃতিক আলো ব্যতীত অতিরিক্ত যে কোনো কৃত্রিম আলোকসজ্জাকেই আলো দূষণের আওতায় ফেলা হয়। International Dark-Sky Association এর মতে, কৃত্রিম আলোর অনুপযুক্ত বা অতিরিক্ত ব্যবহারই হল আলো দূষণ।

রাতের কলকাতা

মানবসভ্যতার প্রাক্-লগ্ন থেকে যে জিনিসটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সবথেকে বেশি গুরুত্ব পেয়ে এসেছে, তা হল আলো। পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালানো থেকে শুরু করে জ্যোৎস্নারাতে চাঁদের আলো, কিংবা হালফ্যাশনের এলইডি লাইট, অথবা রাস্তাজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাতিস্তম্ভ– বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে আলোর উৎসেরও বিবর্তন ঘটেছে। আর এই বিবর্তন পরোক্ষে ডেকে এনেছে ‘বিপদ’। আলোর পাশাপাশি, এই বাস্তুতন্ত্রের জন্য অন্ধকারও যে জরুরি সেটা বোধহয় আমরা বুঝতে পারিনি।

ধরা যাক, আপনার বাড়ির সামনের দিকে আপনি একটি বাগান করেছেন। দীর্ঘদিনের কায়িক পরিশ্রমে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগিয়ে আপনি সেখানে একটি ছোটো বাস্তুতন্ত্র গড়ে তুলেছেন। সেই বাগানের শোভাবর্ধনের উদ্দেশ্যে আপনি বাগানের কিছু অংশে ছোটো এলইডি আলো, কিছু অংশে রঙিন হ্যালোজেন আলো দিয়ে তাকে আরও দৃষ্টিনন্দন করে তুললেন। যেমনটা অনেক বাগান বা পার্কেই আকছার দেখা যায়। এইবার রাতের বেলা এইসব আলো একসাথে জ্বালিয়ে আপনি অনুভব করলেন চোখের আরাম। কিন্তু আপনি যেটা উপলব্ধি করতে পারলেন না সেটা হল আপনার অজান্তেই আপনি ঘটিয়ে ফেলেছেন আলোক দূষণ।

কীভাবে? আপনার বাগানে যেসব গাছপালা আছে, তারা দিনের বেলায় সালোকসংশ্লেষ করে এ কথা আমরা সকলেই জানি। দিনের বেলা ছাড়াও রাতের বেলাতেও উদ্ভিদদেহে শ্বসনসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক ক্রিয়া ও বিপাকক্রিয়া চলতে থাকে। আপনার বাগানে গোটা রাত তীব্র হ্যালোজেন আলো জ্বলতে থাকলে উদ্ভিদদেহে সেইসব বিক্রিয়ার কী হবে সেটা একবার কল্পনা করুন। বিভিন্ন মৌসুমী উদ্ভিদের ফুল ও ফলদান দিন ও রাতের দৈর্ঘ্যের উপর নির্ভর করে। কিন্তু আলোক দূষণে কৃত্রিম আলোর পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে উদ্ভিদের ফুল ও ফল উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এছাড়া আপনার বাগানে যখন গাছ রয়েছে, তখন চারপাশ থেকে একাধিক পাখিও নিশ্চই সেইসব গাছে এসে বাসা বাঁধবে। সন্ধ্যে নামলেই চোখ ধাঁধানো আলোর জেরে ওইসব পাখিরা বাসা খুঁজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবে। সর্বোপরি তীব্র আলো থাকার দরুণ গভীর রাতে ওইসব পাখির ঘুমের ব্যাঘাত অবধি ঘটতে পারে। যদি ঐ বাগানের আশেপাশে কোনো নিশাচর প্রাণী থেকে থাকে, তাহলে তারা রাতের বেলায় কৃত্রিম আলোয় শিকার করতে বের হবে না। এইভাবে দিনের পর দিন কৃত্রিম আলো জ্বালানোর ফলে কিছুদিন পর থেকে দেখবেন আপনার বাগানে পাখির সংখ্যা কমতে শুরু করেছে।

আলোক দূষণের মাত্রা অনুযায়ী দৃশ্যমান আকাশ

শুধু কাল্পনিক উদাহরণই নয়। এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে বাস্তব জগতেও। বিশ্বের কোটি কোটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু সিডনির অপেরা হাউস। রাতের বেলায় এই অপেরা হাউসের কৃত্রিম উজ্জ্বল আলোতে প্রলুব্ধ হয়ে কিছু পাখিকে এদিক সেদিক উড়তে দেখা যায়। উজ্জ্বল আলোতে দিকভ্রান্ত হয়ে এরা বাসায় ফেরার রাস্তা হারিয়ে ফেলে।একটানা দিকভ্রান্ত হয়ে ওড়ার ফলস্বরূপ ক্লান্তদেহে এরা আছড়ে পড়ে আশেপাশের কোনো বিল্ডিংয়ের গায়ে। এই একই কারণে উত্তর আমেরিকায় প্রায় ২০০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি রাতের আকাশে তাদের গতিপথ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। হ্যাঁ! এতটাই ভয়ানক হতে পারে আলোক দূষণের পরিণাম।

ইতালির এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ রাতে প্রকৃতির আলো বুঝতে পারেন না। তার কারণ কৃত্রিম আলোর আধিক্য। পিছিয়ে নেই ভারতবর্ষও। শহর, মফঃস্বল থেকে গ্রাম– সূর্যাস্তের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত জ্বলছে কৃত্রিম আলো। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১২-২০১৬ সালে ভারতের আলোকিত অঞ্চলের সংখ্যা প্রায় ৩৩% বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুতের ব্যবহার যত বেড়েছে, তত আলোও বেড়েছে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে উন্নতি হলেও প্রকৃতির ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞেরা। ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে আকাশের উজ্জ্বলতা সাধারণত জনবসতি শূন্য অঞ্চলের থেকে প্রায় ১০০ গুণ বেশি থাকে। ২০১৭ সালের একটি রিপোর্ট অনুসারে, পৃথিবীর সাপেক্ষে ভারতে রাত নষ্ট হচ্ছে প্রায় তিনগুণ বেশি হারে। এই ধরনের গণনা সাধারণত কৃত্রিম উপগ্রহের ছবি বিশ্লেষণ করে ও অন্য গাণিতিক সূত্রের সাহায্য নিয়ে করা হয়। ২০১২-১৩ সালের হিসেবে হংকংয়ের আকাশ ছিল সবথেকে বেশি আলোকিত। ২০১৬ সালে এই স্থান নেয় সিঙ্গাপুর।

১৯৯৩ থেকে ২০১৩ অবধি ভারতের বিভিন্ন শহরে আলোক দূষণের চিত্র (উল্লেখ্য উক্ত সময়কালের মধ্যে গুজরাট, পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ুর আলোক দূষণের মাত্রা উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে)

উদ্ভিদ ও পশুপাখির ওপর আলোক দূষণের প্রভাব কতটা মারাত্মক হতে পারে তা তো আগেই বললাম। মানবদেহেও এই আলোক দূষণ সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। রাতের অন্ধকারে মানবদেহে এক ধরনের বিশেষ হরমোন নিঃসৃত হয়, যার নাম মেলাটোনিন। রাতের বেলা পর্যাপ্ত ঘুমের জন্য এই হরমোন বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাতের বেলা ঘুমোনোর সময় দিনের পর দিন যদি আমরা কৃত্রিম আলো ব্যবহার করি তাহলে ধীরে ধীরে আমাদের শরীরে মেলাটোনিন নিঃসরণ কমতে থাকে। এর ফলে আমাদের ঘুমের সমস্যা, মাথাব্যথা, অবসাদ, চিন্তা, মানসিক অশান্তি প্রভৃতি সমস্যাগুলো ক্রমান্বয়ে দেখা দিতে শুরু করে। কৃত্রিম আলো প্রয়োগ করলে মানুষের মত বিভিন্ন সরীসৃপ বা উভচর প্রাণীদের দেহেও মেলাটোনিন নিঃসরণের একইরকম প্রভাব দেখা যায়।

মেলাটোনিনের নিঃসরণ কমে যাওয়াতে নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের প্রবণতাও নাকি বাড়ছে। ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনিস্টিউট ও ন্যাশনাল ইনিস্টিউট অফ ইনভায়েরনমেন্টাল হেলথ সার্ভিসের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে নাইট শিফটে যে সকল মহিলারা কাজ করেন তাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ছে। বিজ্ঞানীদের মতে রাতের অতিরিক্ত কৃত্রিম আলোই এই ধরনের ক্যান্সারের জন্য দায়ী। ‘দ্য নিউইয়র্ক অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স’-এর আলোচনাতেও এই একই কথার উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশ্বের বড়ো বড়ো শহরগুলিতে আলোক দূষণ যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি তাকে প্রতিহত করার জন্য বিশ্বজুড়ে নানা রকম গবেষণাও চলছে। আলোর দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৮৮ সালে গঠিত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল ডার্ক স্কাই অ্যাসোসিয়েশন’। এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করছেন তাঁরা। আমেরিকায় তো ‘অ্যান্টি লাইট পলিউশন’ আইনও আছে। এই আইনে অবাঞ্ছিত আলো ব্যবহারের উপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সেখানে প্রয়োজনে শাস্তির ব্যবস্থাও রয়েছে। এ ছাড়াও আমেরিকার ‘দ্য ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিস’-এর ‘ন্যাচরাল সাউন্ড অ্যান্ড নাইট স্কাইজ ডিভিশন’-এর উদ্যোগে বিভিন্ন ন্যাশনাল পার্ক ও অভয়ারণ্যের আকাশ পরিদর্শন করা হচ্ছে। এইসব অঞ্চলে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কৃত্রিম আলো ব্যবহার করা হলে আইন অনুযায়ী রাতের একটি নির্দিষ্ট সময় সব আলো নিভিয়ে রাখার পরামর্শও দেওয়া হয়।

বামদিকে: আলো দূষণে দেখা যাচ্ছে না মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। ডানদিকে: আলো দূষণ নেই এমন স্থানে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আমাদের দেশে জাতীয় স্তরে এইধরনের কোনো আইন প্রণয়ন বা নিদেনপক্ষে কোনো কমিটি পর্যন্ত গঠন করা হয়নি। ফলাফল যা হবার তাই হচ্ছে। ভারতের মেগাসিটিগুলির কোনোটিতেই এখন আর পরিষ্কার আকাশ দেখা যায় না। রাতের আকাশে মিল্কিওয়ে দেখতে হলেও আমাদের ছুটতে হয় কোনো খোলা মাঠ, অথবা প্রত্যন্ত গ্রামের গভীরে। শহরের মানুষদের জীবনযাত্রায় কৃত্রিম আলোর ব্যবহার এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে রাতের বেলাতেও উজ্জ্বল হয়ে থাকছে শহরের বায়ুমণ্ডল। এর প্রভাব এতটাই ধীর গতির যে আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একে অতটা গুরুত্বের সাথে নিই না। কিন্তু আজ সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে ক্ষতিকর প্রভাবের দিক দিয়ে কোন অংশেই এই দূষণ কম নয়। আমরা সচেতন না হলে অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ বিপদে সম্মুখীন হতে হবে আমাদেরই।

তথ্যসূত্র:

আলোর থেকেও হচ্ছে দূষণ, প্রশ্ন সচেতনতা নিয়ে, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯
Light pollution on the rise in India: Study