ন
ভারতের সংবিধান। হাতে লেখা এত বড় সংবিধান বিশ্বের আর কোনো সার্বভৌম দেশে নেই। বলা হয় ১৯৩৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রথম দাবি করে যে, কোনোরকম বিদেশি হস্তক্ষেপ ছাড়াই ভারতীয়দের নিজেদের সংবিধান রচনার অধিকার দিতে হবে। এমনকি সেই সময় পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে একটি গণপরিষদ গঠনের দাবিও জানান। বহু রাজনৈতিক বাদানুবাদের পর ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর নয়াদিল্লির ‘কনস্টিটিউশন হল’-এ বেলা ১১টায় গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। মুসলিম লিগের প্রতিনিধিরা এই অধিবেশনে যোগদান করেননি। তাদের অনুপস্থিতিতে ২০৭ জন প্রতিনিধি নিয়ে সভার কাজ শুরু হয়। ১১ই ডিসেম্বর ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ গণপরিষদের স্থায়ী সভাপতি এবং সচ্চিদানন্দ সিংহ অস্থায়ী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হয় ভারতীয় স্বাধীনতা আইন। এই আইন অনুযায়ী ব্রিটিশ ভারত ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান অধিরাজ্য স্থাপিত হয়। ওই একই বছরের ১৪-১৫ আগস্ট মধ্যরাতে গণপরিষদের একটি বিশেষ অধিবেশনে ভারতের শাসনক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়। ক্ষমতা হস্তান্তরের পর গণপরিষদ হয়ে ওঠে ভারতের প্রথম সংসদ।
স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য ১৯৪৭ সালের ২৯এ আগস্ট নবগঠিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার আইনমন্ত্রী ড. ভীমরাও রামজি আম্বেদকরের নেতৃত্বে পাঁচজন সদস্যকে নিয়ে একটি সংবিধান খসড়া প্রস্তুত কমিটি গঠিত হয়। ১৬৫ দিনে এই খসড়া প্রস্তুত কমিটি মোট ১১ টি বৈঠক করে। প্রথম খসড়ায় প্রায় ২০০০টি অ্যামেন্ডমেন্ট রাখা হয়েছিল। খসড়া চূড়ান্ত করে সম্পূর্ণ সংবিধান প্রস্তুত করতে সময় লাগে ২ বছর ১১ মাস ১৮ দিন।
যাইহোক, সংবিধানের খসড়া তো তৈরি। এরপর শুরু হয় এই সংবিধান লেখার কাজ। ইংরেজি হরফে সংবিধানের ক্যালিগ্রাফি করা শুরু করেন সে সময়ের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার প্রেমবিহারী নারাইন রাইজাদা। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর ডাকে ইটালিক হরফ ব্যবহার করেন তিনি। জানা যায়, সংবিধান লেখার সময় মোট ১০০টি পেনের নিব ব্যবহার করা হয়েছিল। সংবিধানের হিন্দি হরফ লেখার ক্ষেত্রে সেই কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন আর এক শিল্পী বসন্ত কিসান বৈদ্য। এরপর আসে সংবিধান চিত্রণের কাজ। দায়িত্ব বর্তায় শান্তিনিকেতনের ওপর। তখন শান্তিনিকেতনের কলাভবনের অধ্যক্ষ নন্দলাল বসু। সংবিধানের মত এত গুরুত্বপূর্ণ নথির অলঙ্করণ তো আর যাকে-তাকে দিয়ে করানো যায় না! তাই নন্দলাল শুরুতেই তাঁর পাঁচজন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে একটি টিম গঠন করে দেন। এঁরা হলেন দীননাথ ভার্গব, কৃপাল সিং শাখাওয়াত, রামমনোহর সিং, জগদীশ মিত্তল ও গৌরী ভঞ্জ (নন্দলালের কন্যা)।
মূলত যে কাজটা তাঁদের করতে হয়েছিল, তা হল প্রত্যেক পাতার চারধারে ৩.৪ ইঞ্চি বর্ডার দিয়ে সেখানে অলঙ্করণ করা। এই অলঙ্করণ আবার ভারতের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক পিরিয়ডের শৈলী (প্রাগৈতিহাসিক মহেঞ্জোদারো অথবা সিন্ধু সভ্যতা থেকে শুরু করে বর্তমান অবধি) অনুসরণ করে আঁকা। আঁকার কাজ মূলত পেন্সিল ও ব্রাশ দিয়ে হলেও রঙের পাশাপাশি গোল্ড-স্প্রের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। সোনার গুঁড়োর সঙ্গে সঙ্গে বনজ আঠা ও বাবুল মিশ্রিত করায় প্রতিটি পাতা ও তার লেখাগুলি আরো উজ্জ্বলভাবে ফুটে ওঠে।
নন্দলাল বসুর হাতে আঁকা ছবি ও প্রেমবিহারী নারাইন রাইজাদার হাতের লেখাসংবিধান লিখছেন প্রেমবিহারী নারাইন রাইজাদা
অলঙ্করণের ক্ষেত্রে এগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি ছিল সংবিধানের প্রচ্ছদ অঙ্কন। নন্দলাল বসু প্রচ্ছদ অঙ্কনের কাজটি সমর্পণ করেন দীননাথ ভার্গবকে। সংবিধানের শুরুর এই পাতায় সারনাথের অশোকের সিংহচতুর্মুখ স্তম্ভশীর্ষকে অন্তর্ভুক্ত করতে নন্দলাল বসু খুবই আগ্রহী ছিলেন। ইতিপূর্বে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে অশোকের সিংহচতুর্মুখ স্তম্ভশীর্ষের একটি প্রতিরূপ প্রথম ভারত অধিরাজ্যের প্রতীক হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। সুতরাং নন্দলাল মনে করেছিলেন এই ‘অশোক স্তম্ভ’-কেই সংবিধানের প্রথম পাতায় রাখা যুক্তিযুক্ত হবে। এই ‘অশোক স্তম্ভ’-র আকার-আকৃতি আমাদের সকলের কাছেই খুব পরিচিত। এই স্তম্ভে চারটি এশীয় সিংহ পরস্পরের দিকে পিঠ করে একট গোলাকার ভিত্তির ওপর বসে থাকে। এরা শক্তি, সাহস, আত্মবিশ্বাস এবং গর্বের প্রতীক। এর নীচে একটি ঘোড়া এবং একটি ষাঁড় রয়েছে, এবং এর কেন্দ্রে একটি চক্র (ধর্ম চক্র) রয়েছে। ষাঁড়টি কঠোর পরিশ্রম ও অবিচলতার প্রতিনিধিত্ব করে, এবং ঘোড়াটি আনুগত্য, গতি ও শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। এছাড়া এই স্তম্ভের নীচে দেবনাগরী লিপিতে লিখিত আছে মুন্ডক উপনিষদের একটি উক্তি: सत्यमेव जयते (সত্যমেব জয়তে, অর্থাৎ সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী)।
প্রথমদিকে ভার্গব নিজের ড্রইং খাতায় একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে সিংহ এঁকে নন্দলালকে দেখাচ্ছিলেন। কিন্তু শুরুর দিকে কোনো আঁকাই নন্দলালের মনঃপূত হচ্ছিল না। তিনি চাইছিলেন, সিংহদের মুখাবয়ব যেন বাস্তবসম্মত হয়। শেষমেষ সিংহ এবং তাদের বিশেষ ধরন সম্পর্কে অধ্যয়ন করার জন্য ভার্গব এক মাস ধরে প্রতিদিন শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা চিড়িয়াখানায় যাতায়াত করা শুরু করলেন। প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে প্রতিদিন চিড়িয়াখানায় গিয়ে সিংহের হুঙ্কার শোনা, তাদের চালচলন মাপা– এসবই তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতেন ভার্গব। তারপর একদিন এল সেই বিশেষ মুহূর্ত। খসড়ার পর খসড়া শেষে একদিন মুখে হাসি ফোটে নন্দলালবাবুর। আর এইভাবে স্তম্ভের প্রতিষ্ঠাও যেন হয় ভার্গবের হাত দিয়ে।
দীননাথ ভার্গব১৯৪৯ সালের ২৪ নভেম্বর এই সংবিধান রাখা হয় কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে, বর্তমানে যা সংসদের সেন্ট্রাল হল নামে পরিচিত। সেই ঘরে এই সংবিধানে সই করেন অ্যাসেম্বলির ২৮৪ জন সদস্য। এর ঠিক দুদিন পর ২৬ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সংবিধান গ্রহণ করা হয়, এবং পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় সংবিধান কার্যকর করা হয়। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো ২৬ জানুয়ারি দিনটিকে মহাত্মা গান্ধী নাম দিয়েছিলেন ‘স্বতন্ত্রতা সংকল্প দিবস’। ১৯২৯ সালের শেষদিকে জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে পূর্ণ স্বরাজ আনার শপথ নেওয়ার পরপরই ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি দিনটিকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে অবশ্য ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে ভারত এবং ওই দিনটি স্বাধীনতা দিবসের মর্যাদা পায়। তাই ভারতীয় ইতিহাসে ২৬ জানুয়ারি দিনটি যেন ভারতবাসী বিস্মৃত না হয়, সেই কারণে সংবিধান প্রণয়নের দিন হিসেবে ২৬ জানুয়ারি দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়।
হাতে লেখা মূল সংবিধানটি সংরক্ষণ করার জন্য সংসদ ভবনের লাইব্রেরিতে একটি বিশালাকার পাত্রের মধ্যে সেটি রেখে দেওয়া হয়েছে। এই পাত্রের আকারও অনেকটা সংসদ ভবনের অনুকরণে তৈরি করা হয়। মূলত আমেরিকান সংবিধান সংরক্ষণের পন্থা অবলম্বন করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ভারতের ‘ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবোরেটরি’ ও আমেরিকার ‘গেটি ইনস্টিটিউট’-এর যৌথ উদ্যোগে সংসদ ভবনে হিলিয়াম গ্যাসপূর্ণ একটি চেম্বার বানানো হয়। ভারতের সংবিধান যে কালো কালিতে লেখা হয়েছিল, তা খুব দ্রুত বাতাসের সঙ্গে বিক্রিয়ায় জারিত হয়ে যায়। এই বিক্রিয়া প্রতিরোধ করতে প্রতি ঘনমিটার আয়তনে প্রায় ৫০ গ্রাম হিলিয়াম গ্যাসের প্রয়োজন। এই নির্দিষ্ট পরিমাণ হিলিয়াম মজুত থাকছে কিনা, তা প্রতিনিয়ত পরিমাপ করা চলতে থাকে। বলা বাহুল্য বছরে একবার করে এই পাত্র থেকে হিলিয়াম গ্যাস সম্পূর্ণ বের করে পুনরায় নতুন হিলিয়াম গ্যাস প্রবেশ করানো হয়।
হিলিয়াম গ্যাসপূর্ণ পাত্রে সংরক্ষিত সংবিধানভারতের এই সংবিধান পরে ফটোলিথো করে রাখে সার্ভে অফ্ ইন্ডিয়া। এই সংবিধানের মুদ্রণের কাজ সম্পন্ন করা হয় দেরাদুনে। পার্চমেন্ট কাগজে ২৫১ পৃষ্ঠার আকর গ্রন্থটির ওজন প্রায় ৩ কিলো ৭৫০ গ্রাম। অনেকে বলেন ভারতের সংবিধান পুরোপুরি মৌলিক নয়। ১৯৩৫ সালের ‘ভারত শাসন আইন’ থেকে সংবিধানের মূল কাঠামোটি সাজানো হয়েছে। বাকি অনেককিছুই বিভিন্ন দেশের সংবিধানের ভাষা ধার করে বানানো। যেমন ফ্রান্সের সংবিধান থেকে ‘স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ব’ কথাটি নেওয়া হয়েছে। অথবা জাপানের সংবিধান থেকে ‘আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত’ শব্দবন্ধ নেওয়া হয়েছে। কিংবা মার্কিন সংবিধান থেকে ‘We the people’ ধার করা হয়েছে ইত্যাদি।
পুনশ্চ: সংবিধানের এক একটি অধ্যায় অলঙ্করণের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নন্দলাল সেগুলি দিল্লি পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। দীননাথ ভার্গব প্রচ্ছদ ছাড়াও প্রথম ৩০ পাতা অলঙ্করণের দায়িত্বে ছিলেন বটে, কিন্তু কাজ চলাকালীন তিনি কোনোদিনই সম্পূর্ণ সংবিধান চোখে দেখেননি। ২০০৬ এ ‘ললিত কলা অ্যাকাডেমি’ ঘুরতে এসে তিনি প্রথম স্বচক্ষে সম্পূর্ণ সংবিধান দেখেন। তাঁর বয়স তখন ৭৯ বছর।
তথ্যসূত্র:
1 মন্তব্যসমূহ
অনবদ্য উপস্থাপনা.. শুভেচ্ছা রইল।
উত্তরমুছুন