বাঙালি জাতির সঙ্গে ‘সার্কাস’ ঘরানার পরিচয় মূলত ইংরেজদের সূত্র ধরে। ইংরেজ শাসকদের দৌলতে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও শিক্ষার পাশাপাশি বিলিতি বিনোদনের ঢেউও এদেশে এসে পৌঁছেছিল। এখানে বলে রাখা ভালো, এইসব বিনোদনের মাধ্যমগুলি সব সময় নিছক আনন্দলাভের জন্যই প্রচলিত ছিল না, বরং এগুলির সঙ্গে মিশে ছিল জাতীয়তাবাদের ভাবনা। অর্থাৎ বিদেশি শাসকদের রীতিনীতি রপ্ত করে একপ্রকার তাদেরকেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার মত সাহস।

ভারতীয় সার্কাসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যাঁর নাম সবার ওপরে উঠে আসে, তিনি বিষ্ণুপন্থ ছত্রে। ইনি সর্বপ্রথম বোম্বে প্রেসিডেন্সিতে সার্কাস কোম্পানি খোলেন। পরে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি এবং ত্রিবাংকুরেও সার্কাস শুরু হয়। ‘মালাবার সার্কাস কোম্পানি’ নামে কেরালায় একটি সার্কাস ট্রেনিং স্কুলও চালু হয়। সারা দেশ ঘুরে ঘুরে এই সার্কাস জাগলিং, ট্রাপিজ, জাদু, সাইক্লিং ইত্যাদি নানারকমের খেলা দেখাত।

বাঙালির সার্কাস জগতের হাতেখড়ি হয়েছিল হিন্দুমেলার প্রতিষ্ঠাতা নবগোপাল মিত্রের ‘ন্যাশনাল সার্কাস’-এর হাত ধরে। এই সার্কাস ছিল মূলত দুটি ঘোড়া ও কিছু জিমন্যাস্টের নিজস্ব ক্রীড়া প্রদর্শন। পরে নবগোপাল মিত্রের জামাই রাজেন্দ্রলাল সিংহ ১৮৮৩ সালে কিছু বিদেশি খেলোয়াড়দের সঙ্গে নিয়ে শুরু করেন ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস’। এই সার্কাস ছিল মূলত বিদেশি জিমন্যাস্টদের খেলা। সেই সময়ে সার্কাসে হিংস্র পশুর চল শুরু হয়নি সেভাবে।

তবে আজকের দিনে আধুনিক সার্কাস বলতে আমাদের চোখের সামনে যে ছবিটা ভেসে ওঠে তার সূত্রপাত ‘গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে। এই সার্কাস কোম্পানির মালিক ছিলেন ছোটো জাগুলিয়ার মতিলাল বসু। পরে ১৯০৯ সালে প্রিয়নাথ বসু এই গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের মালিকানা লাভ করেন, এবং গ্রেট বেঙ্গলের নাম পাল্টে তিনি রাখেন ‘প্রফেসর বোসেস গ্র্যান্ড সার্কাস’। ইতিহাস বলছে এই প্রিয়নাথ বসু ছিলেন ‘হিন্দু মেলা’-র আয়োজক মনোমোহন বসুর ছেলে। প্রিয়নাথদের বাড়ির পেছন দিকে একটি সুসজ্জিত ব্যায়ামাগার ছিল। সেখানে ব‍্যয়াম শিখতে আসতেন কলকাতার রামবাগান নিষিদ্ধপল্লীর দুই বোন– সুশীলাসুন্দরী ও কুমুদিনী। বলা চলে এখান থেকেই সুশীলাসুন্দরী ও প্রিয়নাথ বসুর একে অপরের সঙ্গে সখ্য, এবং অবশ্যই আমাদের গল্পের সূত্রপাত।

--

সুশীলার জন্ম কলকাতার রামবাগান অঞ্চলে ১৮৭৯ সালে। ছোটোবেলা থেকেই ঘোড়সওয়ারিতে আগ্রহ ছিল সুশীলার। তৎকালীন গোঁড়া হিন্দু সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি শিখতে শুরু করেন ঘোড়া চালনা ও জিমন্যাস্টিক। মূলত পেটের টানে পরবর্তীকালে সুশীলাসুন্দরী ও তাঁর বোন কুমুদিনী প্রিয়নাথ বসুর সার্কাস দলে নাম লেখান।

১৮৮৬ সালের নভেম্বর মাসে প্রিয়নাথ বসুর সার্কাস দল খেলা দেখাতে যায় মধ্যপ্রদেশের রেওয়ায়। সার্কাসের খেলা দেখে খুশি হয়ে সেখানকার মহারাজা অন‍্যান‍্য অনেক উপহারের সঙ্গে প্রিয়নাথের হাতে তুলে দিয়েছিলেন সুন্দরবনের দুটি বাঘের বাচ্চা। একটি পুরুষ, অন্যটি মেয়ে। দীর্ঘ কয়েক বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ভাগ্য ফিরেছে বলে এই দুটি বাঘের বাচ্চার নাম রাখা হয়– লক্ষ্মী ও নারায়ণ। 

১৯০১ সালে সুশীলা এই সার্কাসে বাঘের খেলা দেখানোর জন্য মনঃস্থির করেন। প্রিয়নাথ বসু নিজে উদ্যোগ নিয়ে সমস্ত ব্যবস্থা করে দেন। দিনরাত এক করে চলতে থাকে সুশীলা ও লক্ষ্মী-নারায়ণের অনুশীলন পর্ব। ওই বছরই ২১শে নভেম্বর ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকায় ছবিসমেত ফলাও করে ছাপা হয় একটি রিপোর্ট।

Hindu women are notoriously most timid but in the person of Sushila, there is one who, with the utmost fearlessness, enters the den of two apparently savage beasts, without either whip or any kind of defensive appliance, and goes through her performance with these animals with a nerve and fearlessness really startling to witness.

অচিরেই দক্ষ ট্র‍্যাপিজ খেলোয়াড়, জিমন‍্যাস্ট হিসেবে নামডাক হয় সুশীলাসুন্দরীর। রাতারাতি জনপ্রিয়তা লাভ করেন সার্কাস জগতের প্রথম বাঙালি মহিলা রিংমাস্টার সুশীলাসুন্দরী দেবী।

সুশীলার আগে যেরকম বাঘের খেলা জনপ্রিয় হয়েছিল সেগুলিতে বাঘকে গলায় চেন পরিয়ে রাখা হত। গ্রেট ইন্ডিয়ানের বাদলচাঁদ ছিলেন সেই খেলার অন্যতম পুরোধা। কিন্তু সুশীলা এসে পাল্টে দিলেন সংজ্ঞা। তাঁর খেলা দেখানোর সময় বাঘেরা থাকত মুক্ত। তিনি সরাসরি মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে বাঘের খাঁচায় ঢুকতেন। নিজের অঙ্গুলিহেলনে বাঘকে দিয়ে গর্জন করাতেন, দাঁড় করাতেন, বসিয়ে দিতেন, আর তাঁবুতে উপস্থিত উৎসাহী জনতা মুগ্ধ চোখে দেখতেন সুশীলার সেই ‘ম্যাজিক’।

এরপর ১৯১০ সাল নাগাদ সার্কাসে আরও লোক টানতে সুশীলা এর থেকেও ভয়ানক খেলা দেখানো শুরু করলেন। বাঘের সঙ্গে কুস্তি। একই খাঁচায় বাঘের সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিজের পেশিবল দেখাতেন তিনি। শুধু তাই নয়, দু-হাতে বাঘের মুখ হাঁ করে চোয়াল উন্মুক্ত করে দিতেন দর্শকদের সামনে। খেলার পর বাঘের গায়ে হেলান দিয়ে তিনি বসতেন, কিছুক্ষণ পর খাঁচার বাইরে বেরিয়ে এসে কুড়োতেন মুগ্ধ দর্শকদের হাততালি। এই খেলা এতটাই জনপ্রিয় হয়, যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বারেবারে খেলা দেখানোর অনুরোধ আসতে থাকে।

সুশীলাসুন্দরী
সুশীলা (মাঝের সারির ডানদিকে) ও কুমুদিনীর (মাঝের সারির বাঁদিকে) পিরামিডের খেলা

--

দীর্ঘ বাইশ বছরেরও বেশি সময় সার্কাস দলের সঙ্গে যুক্ত থাকায় যাদুগুরু গণপতি চক্রবর্তীর সঙ্গে প্রণয়ঘটিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন সুশীলা দেবী। তখনকার দিনে গণপতিবাবু ‘প্রাচ্যের হুডিনি’ নামে খ্যাত ছিলেন। তবে পরবর্তীকালে প্রিয়নাথ বসুর দল ছেড়ে গণপতি যখন নিজের সার্কাস দল গড়েন, সুশীলাসুন্দরী সেখানে যোগ দেননি। তিনি থেকে গিয়েছিলেন প্রিয়নাথের দলেই। গ্র্যান্ড সার্কাসের সঙ্গে তাঁর ছিল এমনই সম্পর্ক।

পরবর্তীকালে সুশীলা বিবাহ করেন প্রিয়নাথের ভাই তথা সেই সময়ের ডাকসাইটে কুস্তিবিদ মতিলাল বসুকে। এই মতিলাল ছিলেন আবার নরেন্দ্রনাথ দত্তের (পরবর্তীতে স্বামী বিবেকানন্দ) অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

দীর্ঘ কুড়ি বছর লক্ষ্মী আর নারায়ণকে নিয়ে খেলা দেখানোর পর অকস্মাৎ একদিন একটি বাঘের মৃত্যু হয়। এরপর ‘ফরচুন’ নামে অন্য একটি বাঘকে নিয়ে খেলা দেখানো শুরু করে গ্র্যান্ড সার্কাস। আর এই বাঘকে নিয়ে খেলা দেখাতে গিয়ে ঘটে যায় এক বিপত্তি। সুশীলা দেবী একদিন যখন ছবি তোলার জন্য তাঁর বিশেষ ভঙ্গিতে বাঘের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেই সময় সে থাবা দিয়ে সুশীলা দেবীকে মারাত্মক জখম করে। শোনা যায়, সেদিন বাঘটিকে উপযুক্ত খাবার দেওয়া হয়নি। ফরচুনের আক্রমণে জখম হয়ে সুশীলা দেবী বাকি জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান। তারপর ১৯২৪ সালের মে মাসে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে সার্কাস মঞ্চ থেকে অকালে বিদায় নিয়ে মারা যান পরাধীন ভারতের প্রথম বাঙালি সার্কাস-কন্যা সুশীলাসুন্দরী।

তথ্যসূত্র: