‘পাঁচ ভাই, একসাথ / মারছে ঘুঁষি, খাচ্ছে ভাত / আরও পাঁচ সাথে তার / কেমন আছেন? নমস্কার!’— ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর রুকুর মুখে এই বিখ্যাত হেঁয়ালিটা নিশ্চই আপনার মনে আছে! তাহলে এর উত্তরে ফেলুদার একপেশে হাসি হেসে নমস্কারের ভঙ্গিতে পর্দায় তাকানোর কথাও নিশ্চই আপনার মনে থাকবে। এই নমস্কার বিষয়টি বাঙালি ঘরানার এক নিজস্ব সম্ভাষণের ভঙ্গি। ‘বাঙালি’ উল্লেখ করলাম বটে, তবে বর্তমানে কিন্তু অনেক অবাঙালি সম্প্রদায়, বিশেষত হিন্দুদের মধ্যে এই ধরনের ‘নমস্তে’-র ব্যবহার আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করে থাকি।

আসলে ‘নমস্কার’ বিষয়টিই খাঁটি ভারতীয়। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়াও নেপালে, এবং প্রবাসী ভারতীয়দের সংস্কৃতিতে নমস্কারের প্রচলন রয়েছে। হাতের তালুদুটি পরস্পর সংলগ্ন করে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ বুকের কাছে রাখার এই ভঙ্গিটিকে অঞ্জলি মুদ্রা বা প্রণামাসন বলা হয়। এই নমস্কার রীতির উদ্ভবের ইতিহাস কিন্তু বেশ প্রাচীন। সিন্ধু সভ্যতায় খননকার্যে উঠে আসা পুরুষ ও নারীর টেরাকোটা মূর্তিগুলির মধ্যে এমন অনেকগুলি মূর্তি পাওয়া গেছে, যারা নমস্কার ভঙ্গিরত। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এই মূর্তিগুলি আনুমানিক ৩০০০ থেকে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ তৈরি করা হয়ে থাকতে পারে। অতএব বোঝাই যাচ্ছে, ভারতীয় রীতিনীতিতে নমস্কারের ঐতিহ্য কতটা পুরোনো।

সোমনাথপুর মন্দিরের প্রাচীন কারুকার্য

তবে আজকাল আর বাঙালি খুব একটা নমস্কারের ধার ধারে না। বাঙালি এখন ‘আধুনিক’ হয়েছে, বাঙালি এখন কথায় কথায় বিদেশ যাচ্ছে। তাই নমস্কার ছেড়ে বাঙালি এখন আপন করে নিয়েছে ‘হ্যান্ডশেক’-কে। তা সে কর্পোরেট সেক্টরের চাকরিতেই হোক, অথবা বন্ধুদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্ভাষণে— দুজন দুজনের হাত ধরে একটু ঝাঁকিয়ে দিয়ে চট করে সেরে নেওয়া যায় ‘হ্যান্ডশেক’। এই ধরা যাক ‘হট শট’ ছবিতে টপার হার্লে আর টেন্ট গ্রেগোরির সেই মজাদার হ্যান্ডশেকের ঘটনাটা। দুই পাইলট বন্ধুর মধ্যে তর্কাতর্কি যখন চরমে, দর্শক যখন ভাবছেন এই বুঝি এ ওর নাকে ঘুঁষি চালিয়ে দিল, ঠিক তখনই দুজন এগিয়ে এসে একে অপরের সঙ্গে দৃঢ় ভাবে হ্যান্ডশেক করলেন। মানে সব বিবাদ মিটিয়ে নাও ভায়া, আজ থেকে আমরা আবার বন্ধু হলাম!

এছাড়া খেলার মাঠের কথাই ধরুন। ক্রিকেটে টসের পর দুই দলের অধিনায়কের করমর্দন, কিংবা ফুটবল ম্যাচের শেষে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের সঙ্গে হাত মেলানো— এসবই আমাদের কাছে চিরপরিচিত দৃশ্য। বহুল পরিচিত এই হ্যান্ডশেকের উদ্ভব কিন্তু এদেশে নয়। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রীস দেশে করমর্দন শুরু হয়েছিল শান্তি স্থাপনের সংকেত হিসেবে। এর মাধ্যমে বোঝানো হত দুজনের কারও হাতেই কোনো অস্ত্র নেই। রোমান সভ্যতায় হাত মেলানোর পরিসর ছিল আরেকটু বড়। পরস্পরের সঙ্গে বাহু মিলিয়ে সম্ভাষণ করত তারা। উদ্দেশ্য একই— জামার আস্তিনের নীচে কোনো অস্ত্র লুকানো নেই, তা জানান দেওয়া। সামরিক পদমর্যাদার নাইটরাও নাকি একে অপরের হাত ধরে হ্যান্ডশেক করতেন যাতে কেউ কোনোভাবে পোশাকের আড়ালে অস্ত্র লুকিয়ে রাখতে না পারে।

করমর্দনের ইতিহাসের উপর একটি বই লিখেছেন ব্রায়ান চালর্স বার্ক। তাঁর মতে অনেক আগে থেকেই করমর্দনের প্রচলন হলেও মূলত উনিশ শতকের দিকে এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রাচীনকালে মানুষ শুধু মৌখিক কথার উপর কোনোকিছু বিশ্বাস করতেন না। সেই বিশ্বাস পাকাপোক্ত করার জন্য পরস্পরের হাতে হাত মেলাতেন তারা। তাঁদের ধারণা ছিল এই করমর্দনের মাধ্যমে তাদের হাতের ছোঁয়া বিশ্বাসের এক অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠবে। এই কারণে বর্তমান সময়েও বিশ্বাসের প্রতীক হিসাবে করমর্দনকে ব্যবহার করা হয়। ব্যবসায়িক বা অন্যান্য ক্ষেত্রে কোনো চুক্তি সম্পন্ন হলে হাত ঝাঁকিয়ে একে অপরের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করা হয়।

খ্রিষ্টপূর্ব নবম শতকের একটি শিলাখণ্ড

খ্রিষ্টপূর্ব নবম শতকে অ্যাসিরীয় (বর্তমান ইরাক) সম্রাট তৃতীয় শালমানেসের শাসনকালের একটি শিলাখণ্ড থেকেও গবেষকেরা করমর্দনের প্রমাণ পেয়েছেন। এই শিলাখণ্ডে দেখা যায়, সম্রাট একজন ব্যাবিলনীয় শাসকের সঙ্গে করমর্দন করছেন। মহাকবি হোমার ইলিয়াড ও ওডিসিতে বহুবার শপথ এবং অঙ্গীকার করার সময় করমর্দন করার কথা উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয়, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ ও পঞ্চম শতকের গ্রিক কবরের এপিটাফে খোদাই করা ছবিতেও করমর্দনরত মানুষের দেখা পাওয়া যায়।

নমস্কার ও হ্যান্ডশেক ছাড়া আরও দু ধরণের হাতমিলান্তির প্রকারভেদ দেখা যেতে পারে। মূলত সমবয়সীদের মধ্যে এই দু ধরণের সম্ভাষণ বেশি লক্ষ্য করা যায়। এদের মধ্যে একটি হল হাই-ফাইভ, এবং অপরটি ফিস্ট বাম্প।

হাই-ফাইভের প্রচলন বিংশ শতকের শুরু থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে লক্ষ্য করা গিয়েছিল। তবে এই ধরনের হাই-ফাইভকে একেবারে আন্তর্জাতিক মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিল ১৯৭০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসবল ম্যাচ। এই ম্যাচের দুই প্রতিযোগী দল ছিল লস অ্যাঞ্জেলেস ডজার্স ও হিউস্টন অ্যাস্ট্রস। খেলার শেষ দিকে তখন টানটান উত্তেজনা। ডজার্সের খেলোয়াড় ডাস্টি বেকার সজোরে ব্যাট দিয়ে বল মেরে ছুট লাগালেন। ডাস্টি বেকার যখন তাঁর হোম রান শেষ করলেন, তখন মাঠে থাকা সতীর্থ গ্লেন বার্কে উত্তেজনায় হাত আকাশে তুলে ধরলেন। কিছু না বুঝে বেকারও হাত তুলে দিলেন আকাশে। মিলল দুজনের হাতের তালু। ESPN-এর প্রতিবেদনে ‘দ্য হাই-ফাইভ’ শিরোনামে এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে ইতিহাসের প্রথম হাই-ফাইভকে। সেই থেকে উচ্ছ্বাস প্রকাশের রীতি হিসেবে আজও সমবয়সীদের মধ্যে হাই-ফাইভের ব্যবহার চলে আসছে।

বেসবল মাঠে প্রথম হাই-ফাইভ

হাই-ফাইভের মতই খেলার মাঠে প্রচলন হয়েছিল ফিস্ট বাম্পেরও। ১৯৭০ বা তার আশেপাশের সময়ে বাস্কেটবল কোর্টে ফ্রেড কার্টারের হাত ধরে প্রথম এই অভিনব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে বেসবল, ফুটবল, এমনকি ক্রিকেটের মাঠেও ছক্কা হাঁকিয়ে ফিস্ট বাম্প করা শুরু হয়।

তবে এই সবকিছুর মধ্যে ভারতীয় হিসেবে প্রাপ্তির কথা একটাই, এই মহামারী পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে নমস্কারের প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে। দুই ভিন্ন ব্যক্তির হাতের স্পর্শে মহামারীর জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত গতিতে। তাই ভারতীয় রীতির অনুকরণে তাবড় বিশ্বনেতারাও আজকাল একে অপরকে নমস্কার করা শুরু করেছেন। ২০২০-র শুরুর দিকে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী লিয়ো ভারাদকরের নমস্কাররত ছবি আমরা অনেকেই দেখেছি। এও তো পরোক্ষে একপ্রকার ভারতীয় সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার। একজন ভারতীয় হিসেবে এও কি কম গর্বের?

তথ্যসূত্র: