ছেলেবেলা থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর মা সারদাসুন্দরী দেবীর প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ হয়েছে খুবই কম। রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’-র পাতা ওল্টালেই দেখা যাবে পরতে পরতে রয়েছে ঠাকুরবাড়ির নিয়মের বেড়াজাল। তখনকার বনেদী বাড়িগুলিতে এ যেন এক প্রতিষ্ঠিত প্রথা ছিল। সরলা দেবী চৌধুরানী তাঁর একটি লেখায় লিখেছেন, “সেকালের ধনীগৃহের আর একটি বাঁধা দস্তুর জোড়াসাঁকোয় চলিত ছিল। শিশুরা মাতৃস্তন্যের পরিবর্তে ধাত্রীস্তন্যে পালিত ও পুষ্ট হত। এই নিয়ম মেনে ছোট্ট রবিকেও মায়ের কোল থেকে যেতে হয়েছিল ধাত্রী-মায়ের কোলে।” তাঁর এই ধাত্রী-মায়ের নাম ছিল ‘দিগম্বরী’ বা সংক্ষেপে ‘দিগমী’।
এই একইরকম আক্ষেপের কথা রবীন্দ্রনাথের মুখেও শোনা যায়। রবি ঠাকুর মা সারদাদেবী প্রসঙ্গে এক লেখায় বলছেন— “মাকে আমরা পাইনি কখনো, তিনি থাকতেন তাঁর ঘরে তক্তাপোশে বসে, খুড়ির সঙ্গে বসে তাস খেলতেন। আমরা যদি দৈবাৎ গিয়ে পড়তুম সেখানে, চাকররা তাড়াতাড়ি আমাদের সরিয়ে আনতেন, যেন আমরা একটা উৎপাত। মা যে কী জিনিস তা জানলুম কই আর। তাই তো তিনি আমার সাহিত্যে স্থান পেলেন না।” রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর ভাইবোনদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন না। সারদাসুন্দরীর সন্তানের সংখ্যা ছিল পনেরো। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর চোদ্দতম সন্তান। রবীন্দ্রনাথের জন্মের সময় সারদা দেবীর বয়স ছিল চৌত্রিশ। সারদা দেবীর কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন বুধেন্দ্রনাথ। বুধেন্দ্রনাথ খুব অল্প বয়সে মারা যাওয়ার কারণে রবীন্দ্রনাথই হয়ে ওঠেন সংসারের ছোট ছেলে। আদরের মধ্যমণি।
--
সারদাসুন্দরী দেবীর জন্মতারিখ সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া না গেলেও লোকমুখে শোনা যায় তিনি ছিলেন যশোরের দক্ষিণডিহি গ্রামের রামনারায়ণ চৌধুরীর মেয়ে। মাত্র ৬ বছর বয়সে কলকাতার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিবাহ করে তিনি ঠাকুরবাড়িতে এসে ওঠেন। প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিতা না হলেও, সারদাসুন্দরী একেবারে নিরক্ষর ছিলেন না। তাঁর কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখা ‘আমাদের গৃহে অন্তঃপুর শিক্ষা ও তাহার সংস্কার’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, “মাতাঠাকুরাণী তো কাজকর্ম্মের অবসরে সারাদিন একখানি বই হাতে লইয়া থাকিতেন। চাণক্যশ্লোক তাঁহার বিশেষ প্রিয় পাঠ ছিল, প্রায়ই বইখানি লইয়া শ্লোকগুলি আওড়াইতেন। তাঁহাকে সংস্কৃত রামায়ণ-মহাভারত পড়িয়া শুনাইবার জন্য প্রায়ই কোনো না কোনো দাদার ডাক পড়িত।”
খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ‘রবীন্দ্রকথা’ গ্রন্থে সারদা দেবী সম্পর্কে লিখেছেন – “মাত্র ১৮ বৎসর বয়সে তিনটি সন্তানের জননী হইয়া তেজস্বিনী শাশুড়ীর অবর্তমানে যে সারদা দেবীকে দেবদ্বিজ সমন্বিত নিত্যনৈমিত্তিক কার্য ও উৎসব মুখরিত বৃহৎ সংসারের লোকলৌকিকতা, সামাজিকতা ও যাবতীয় ভার কর্ত্রীরূপে বহন করিতে হয় ও অনতিকাল পরেই দিকপাল সম শ্বশুরের তিরোভাবে বিপ্লবের ঝটিকায় নানাবিধ উদ্বেগ সহিতে হয়, সেই পূজনীয়াকে Heroic Lady বলিলে অত্যুক্তি হয় না।”
সারদাসুন্দরী দেবীস্বামী দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন রূপবান ও গুণবান। স্ত্রী সারদাসুন্দরীকে তিনি যেমন ভালোবাসতেন, তেমনই সারদাসুন্দরী দেবীও স্বামীকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতেন। সারদাসুন্দরী ধর্ম নিয়ে পড়েছিলেন বেশ দোলাচলে। স্বামী দেবেন্দ্রনাথ যেমন ছিলেন মূর্তিপূজার বিরোধী তেমনি সারদাসুন্দরী দেবীর শাশুড়ি দিগম্বরী দেবী ও দিদিশাশুড়ি অলকা দেবী ছিলেন ধর্মপ্রাণা মহিলা। এঁদের শিক্ষা এবং ধর্মপ্রবৃত্তি ধীরেধীরে সারদাসুন্দরীকে প্রভাবিত করে। সারদাসুন্দরী নিজে ইষ্টমন্ত্র ও হরিনাম জপ করলেও স্বামীর ধর্মব্যাখ্যা শ্রদ্ধা সহকারে মন দিয়ে শুনতেন। শুনতেন ব্রাহ্মসমাজের নানান কথা। অভ্যেসবশত কোনো কোনো দিন রমানাথ ঠাকুরের বাটীর দুর্গোৎসবের পূজারী কেনারাম শিরোমণির হাতে স্বামীর অজ্ঞাতে কালীঘাটে ও তারকেশ্বরে পুজো দিয়েও পাঠাতেন।
দেবেন্দ্রনাথ ‘দ্বারকানাথ ঠাকুর এস্টেট’-এ সারদাসুন্দরী দেবীর নামে ২৪,৭০০ টাকা দিয়ে একটি ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। তার সমস্ত উপস্বত্ব সারদাসুন্দরীই ভোগ করতেন। এর উপরে ব্যক্তিগত মাসোহারা ছাড়াও কন্যা ও জামাতাদের মাসোহারাও ‘সারদাসুন্দরী দেবী’র খাতে প্রদত্ত হত। মহর্ষি বাড়ি থাকলে সারদাদেবী রান্নাঘরে যেতেন। উপাসনার সময় মহর্ষির কাছে গিয়ে বসতেন। আর ছেলেরা সব ঘুমিয়ে পড়লে একটু রাত করে দেবেন্দ্রনাথ ডেকে পাঠাতেন সারদাসুন্দরীকে। তিনি ধোয়া সুতির শাড়ি পরে একটু আতর মেখে যেতেন স্বামীর কাছে।
সৌদামিনী দেবীর এক লেখা থেকে জানা যায়, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময়ে দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন সিমলায়। দাঙ্গাহাঙ্গামার কারণে অনেককাল বাড়িতে চিঠিপত্র দিতে পারেননি। তাই গুজব রটে যে সিপাহিরা দেবেন্দ্রনাথকে হত্যা করেছে। ব্যস! সেই শুনে সারদাসুন্দরী দেবী আহারনিদ্রা ত্যাগ করে কান্নাকাটি শুরু করে দেন।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরসেকালে ঠাকুর বাড়িতে কী ধরনের পর্দাপ্রথা চালু ছিল, তার পরিচয় আমরা পাই রবীন্দ্রনাথের বড় বোন স্বর্ণকুমারী দেবী এবং মেজ বউদি জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর লেখা থেকে। সেই সময় ঠাকুরবাড়ি ছিল দু ভাগে ভাগ করা। সদরমহল আর অন্দরমহল। বাড়ির মহিলারা অন্তঃপুরেই বাস করতেন। মেয়েদের একই প্রাঙ্গণে এবাড়ি থেকে ওবাড়ি যেতে হলেও ঘেরাটোপ দেওয়া পালকিতে করে যেতে হত। সঙ্গে থাকত জনাচারেক প্রহরী। সারদাদেবীও স্বামীর কাছ থেকে গঙ্গা-স্নানের অনুমতি পেলে বেহারারা পালকি-শুদ্ধ তাঁকে গঙ্গার জলে ডুবিয়ে আনত।
জ্ঞানদানন্দিনীর অন্যান্য লেখা থেকে সারদাদেবীর সৌন্দর্যপ্রীতির কথাও জানতে পারা যায়। একটি লেখায় তিনি উল্লেখ করেছেন, “আমার শাশুড়ী বিকেলে মুখ হাত ধুয়ে তক্তপোশের বিছানায় বসে দাসীদের বলতেন অমুকের ছেলে কি মেয়েকে নিয়ে আয়। তারা কোলে করে থাকত, তিনি চেয়ে চেয়ে দেখতেন, নিজে বড় একটা কোলে নিতেন না। যারা সুন্দর তাদেরই ডাকতেন, অন্যদের নয়।”
শেষ বয়সে সারদা দেবীর শরীর-স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। দীর্ঘ রোগভোগের পর ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন ঠাকুরবাড়ির সারদাসুন্দরী। তারিখটা ১৮৭৫-এর ১১ মার্চ। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন তেরো বছর দশ মাস। সারদা দেবীর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন— “কর্তা-দিদিমা আঙুল মটকে মারা যান। বড়োপিসিমার ছোট মেয়ে, সে তখন বাচ্চা। কর্তা-দিদিমার আঙুল টিপে দিতে দিতে কেমন করে একটু আঙুল মটকে যায়। সে আর সারে না, আঙুলে আঙুল-হাড়া হয়ে পেকে উঠল। জ্বর হতে লাগল। কর্তা-দিদিমা বলতেন, তোরা ভাবিস নে, আমি কর্তার পায়ের ধুলো মাথায় না নিয়ে মরব না, তোরা নিশ্চিন্ত থাক।"
মায়ের মৃত্যুর দিন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’-তে উল্লেখ করেছেন, “আমরা তখন ঘুমাইতে ছিলাম, তখন কত রাত্রি জানি না, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, ‘ওরে তোদের কী সর্বনাশ হল রে!’ তখন বৌ ঠাকুরাণী তাড়াতাড়ি তাহাকে ভর্ৎসনা করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেন। পাছে গভীর রাত্রে আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কা তাঁহার ছিল। ...প্রভাতে উঠিয়া যখন মা’র মৃত্যুসংবাদ শুনিলাম তখনো সে-কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম তাঁহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপরে শয়ান। কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর সে দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না।”
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তখন থাকতেন ডালহৌসি পাহাড়ে। স্ত্রী পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেওয়ার আগে তিনি তাকে শেষ বারের মতো দেখতে এসেছিলেন। পতিব্রতা সারদা দেবী সজ্ঞানে স্বামীর পায়ের ধূলো মাথায় নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আর সেই সঙ্গে সমাপ্ত হয় ঠাকুরবাড়ির প্রতিভার এক অধ্যায়ের।
তথ্যসূত্র:
জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
রবীন্দ্রনাথের মা সারদা দেবী
যেমন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের মা ‘সারদাসুন্দরী দেবী’

.jpeg)
5 মন্তব্যসমূহ
Osadharon sir👍🏻
উত্তরমুছুনএত তথ্য একটি মাত্র ব্লগে! সত্যিই সমৃদ্ধ হলাম। খুব ভালো লাগলো, অপেক্ষায় রইলাম আরও এমনিই সুন্দর লেখা পাঠের।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ লেখা। সারদা সুন্দরীদেবীকে প্রণাম।
উত্তরমুছুনখুব তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। অসাধারণ।
উত্তরমুছুনঅসাধরন
উত্তরমুছুন