‘নিয়নের আলোতে ফোটে জ্যোৎস্না / বাথরুমে শাওয়ারে বয়ে যায় ঝরনা’– বাংলা ব্যান্ড ‘চয়নিকা’-য় অশোক ঘোষের গাওয়া এই গান এখনও আমাদের অনেকের রিংটোনে বাজে। নব্বইয়ের দশকে একটা সময় কলকাতা শহরে এই নিয়নের আলো যে বেশ জনপ্রিয় ছিল, তা সেই সময়কার গান বা কবিতা পড়লেই আন্দাজ করা যায়। এই নিয়ন আলো পরবর্তীকালে রূপান্তরিত হয়ে সস্তার প্রতিপ্রভ আলো বা ইংরেজিতে ‘ফ্লুরোসেন্ট লাইট’ হিসেবে কলকাতার বাজারে বিক্রি শুরু হয়।
এই প্রতিপ্রভার উদাহরণ আমাদের চেনা প্রাণীজগতেও দেখা যায়। ব্যাকটেরিয়া, শৈবাল, জেলিফিশ, কৃমি সহ একাধিক শ্রেণির জলজ প্রাণী প্রতিপ্রভা প্রদর্শন করে। সমুদ্রের গভীরে যত ধরনের প্রাণীর হদিস পাওয়া গেছে তার ৭৬% প্রাণীরাই প্রতিপ্রভা দেখাতে সক্ষম। গবেষকদের মতে মৎস্য শ্রেণির অন্তর্গত প্রায় ১৫০০-রও বেশি প্রজাতি প্রতিপ্রভা প্রদর্শন করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এইসব জলজ প্রাণীরা ব্যাকটেরিয়া বা তার সমগোত্রীয় প্রতিপ্রভ জীবকে নিজদেহে ধারণ করেও প্রতিপ্রভা দেখাতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ববটেল স্কুইডের কথা বলা যেতে পারে। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের এই অদ্ভুত প্রাণীটি জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে এদের দেহে একধনের ব্যাকটেরিয়া কলোনি গঠন করে ফেলে, যা থেকে পরবর্তীকালে জৈব-প্রতিপ্রভা সৃষ্টি হতে পারে।
জীবজগতে প্রতিপ্রভা প্রদর্শনের এইরকম প্রাকৃতিক ঘটনাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বায়োলুমিনেসেন্স (bioluminescence) বলা হয়। বায়োলুমিনেসেন্স দ্বারা উৎপন্ন আলোকে আবার ‘ঠান্ডা আলো’ বা cold light-ও বলা হয়। এর অর্থ, এই প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন আলোর ২০%-এর কম আলো তাপ বিকিরণ বা তাপ উৎপন্ন করতে পারে। বেশিরভাগ সামুদ্রিক বায়োলুমিনেসেন্স দৃশ্যমান আলোক বর্ণালীর নীল-সবুজ অংশে প্রকাশ পায়। এই রঙগুলি আবার গভীর সমুদ্রে আরও সহজে দৃশ্যমান হয়। নীল-সবুজ আলো উৎপাদনের কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। সূর্য থেকে আগত আলোকরশ্মিগুলির মধ্যে নীল-সবুজ আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম, ফলে তা সহজেই সমুদ্রের গভীরে অনেকটা পথ অতিক্রম করতে পারে। আবার তুলনায় দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যযুক্ত রশ্মি, যেমন লাল বা কমলা খুব বেশি গভীরতা পেরোতে পারে না।
বায়োলুমিনিসেন্স প্রদর্শনকারী প্রবাল, জেলিফিশ ও শামুক।জলের নীচে জীবন্ত প্রাণীদেহে এইরকম আলোক উৎপাদনের পদ্ধতিটিও বেশ অদ্ভুত। সমুদ্রের তলদেশে থাকা এইসব বিস্ময়কর প্রাণীদের সম্পর্কে যত বেশি তথ্য পর্যালোচনা করা গেছে, ততই বিজ্ঞানের জগতের এক একটি দিগন্ত খুলে গেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে যেসব সামুদ্রিক প্রাণী প্রতিপ্রভা প্রদর্শন করে তাদের দেহে একধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়, যার ফলে এদের দেহে আলোকশক্তি উৎপাদিত হয়। প্রাণীদেহে এইরকম রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানোর জন্য অত্যাবশ্যকীয় আণবিক পদার্থটির নাম লুসিফেরিন। এই লুসিফেরিন বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে অক্সিলুসিফেরিন নামক জটিল যৌগ গঠন করে এবং পরিবর্তে তাপহীন আলোকশক্তি বিকিরণ করে। বিভিন্ন প্রাণীর ক্ষেত্রে তার চারপাশের পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে এই লুসিফেরিনের গাঢ়ত্বও কম-বেশি হতে পারে। প্রাণীদেহ থেকে কখন কোন রঙ প্রতিফলিত হবে তা এই লুসিফেরিনের সজ্জার ওপর নির্ভর করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে এই রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি ত্বরান্বিত করার জন্য অনেক প্রাণীর দেহে আলাদা করে লুসিফারেজ নামে একধনের উৎসেচক পদার্থ উপস্থিত থাকে।
এই লুসিফেরিন পদার্থকে কাজে লাগিয়ে প্রাণীরা নিজেদের প্রতিপ্রভার ধর্মকে নিয়ন্ত্রণও করতে পারে। অর্থাৎ কখন প্রতিপ্রভা দেখাতে হবে, কখন হবে না, কখনই বা তার কোন প্রয়োজনে প্রতিপ্রভা দেখাতে হবে– এই সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকে প্রাণীদের স্নায়বিক গঠনতন্ত্রের। এমনকি দৃশ্যমান বর্ণালীর কোন রঙ প্রদর্শন করতে হবে, বা প্রতিপ্রভ আলোর তীব্রতা কতটা রাখা হবে সবটাই থাকে তাদের দখলে। কিছু উন্নত শ্রেণির জীবে এই লুসিফেরিন অনুগুলি গুচ্ছাকারে সংঘবদ্ধ অবস্থায় থাকে, এবং পরিবেশ থেকে ক্যালসিয়াম আয়ন সংগ্রহ করে প্রতিপ্রভা প্রদর্শন করে। বলে রাখা ভালো এইসব প্রাণীদের ক্ষেত্রে লুসিফারেজ উৎসেচকের প্রয়োজন পড়ে না।
রেলরোড নামক একধরনের কীটের লার্ভা একইসঙ্গে দুধরনের প্রতিপ্রভ রঙ প্রতিফলিত করতে পারে। এই লার্ভার মাথার দিকটা লাল রঙ এবং দেহের বাকি অংশ হলদেটে সবুজ রঙে প্রতিফলিত হয়। লুসিফারেজ উৎসেচকের গঠনগত তারতম্যের জন্য এই প্রাণী একইসঙ্গে একাধিক রঙের প্রতিপ্রভা দেখাতে পারে। সমুদ্রের গভীরে পচনশীল কাঠের ওপর বসবাসকারী কিছু কিছু ছত্রাকের প্রজাতি পাওয়া যায়, যারা নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রতিপ্রভা বজায় রাখতে পারে। এদেরকে অনেক সময় ফক্সফায়ার নামেও ডাকা হয়ে থাকে। আবার এমন অনেক প্রাণী আছে যারা ১০ সেকেন্ড বা তারও কম ব্যবধানের জন্য প্রতিপ্রভার পুনরাবৃত্তি করে। এই অল্প সময়ের জন্য প্রদর্শিত বায়োলুমিনেসেন্স কোনো কোনো প্রাণীর সমগ্র শরীর জুড়েই দেখা যায়, আবার স্কুইডের মত কিছু কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট স্থানে বিন্দু আকারেও দেখা যায়।
বায়োলুমিনিসেন্স প্রদর্শনকারী রেলরোড কীটের লার্ভা, ফক্সফায়ার ছত্রাক ও ফায়ারফ্লাই স্কুইড।এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এইসব প্রাণীরা কেনই বা জলের গভীরে প্রতিপ্রভা প্রদর্শন করে? জলচর প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই বায়োলুমিনেসেন্সের প্রয়োজনীয়তাই বা কী? এর কারণ হিসেবে একটি নয়, একাধিক তত্ত্বের কথা উঠে আসে।
প্রথমত, গভীর সমুদ্রে সূর্যরশ্মি প্রায় না পৌঁছাতে পারার দরুণ সবসময়ই একরকম আলো-আঁধারি পরিবেশ বিরাজ করে। এই পরিস্থিতিতে জলজ প্রাণীগুলি চলাফেরা ও খাদ্য অন্বেষণের উপায় হিসেবে বায়োলুমিনেসেন্সকে ব্যবহার করে। নিজের দেহ থেকে আলোক বিচ্ছুরণের ফলে এইসব প্রাণীরা তার আশেপাশের কিছুটা অঞ্চল আলোকিত করতে পারে। ফলে সেই আলোকিত অঞ্চলে খাদ্য সন্ধানের কাজ সহজতর হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরা আবার উজ্জ্বল আলো প্রদর্শন করে শিকারকে নিজের কাছে টেনে আনে। মানে সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে যা হয় আর কী! প্রশান্ত মহাসাগরে একপ্রকার অক্টোপাসের প্রজাতি পাওয়া যায়, যার নাম স্টরোটেউথিস। এই অক্টোপাসগুলির উজ্জ্বল আলোয় আকর্ষিত হয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জলজ প্ল্যাঙ্কটনগুলি এদের দিকে ধেয়ে আসে। শুধু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবই নয়, প্রতিপ্রভার আলোয় ধোঁকা খেয়ে স্কুইড, তিমি বা ওই জাতীয় বড়ো বড়ো প্রাণীও নিজের ভক্ষকের দিকে অবলীলায় ছুটে যায়।
দ্বিতীয় কারণটা ঠিক এর উল্টো। এই একই পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে কিছু প্রাণী তাদের ভক্ষককে বিভ্রান্ত করতে পারে। যেমন ধরা যাক গভীর সমুদ্রে বসবাসকারী অক্টোপটিউথিসের কথা। সামুদ্রিক স্কুইডের এই প্রজাতিটি যখন বুঝতে পারে কোনো বড়ো প্রাণী তার গতিবিধি লক্ষ্য করছে, সে চট করে নিজের দেহ থেকে প্রতিপ্রভ অঙ্গের একটি টুকরো খসিয়ে ফেলে। এর ফলে ওই বড়ো প্রাণীটি নিজের শিকার ছেড়ে ওই উজ্জ্বল প্রতিপ্রভ অঙ্গের দিকে ছুটে যায়। যতক্ষণে সে নিজের ভুল বুঝতে পারে, ততক্ষণে তার আসল শিকার সীমানা ছাড়িয়ে পগার পার।
গবেষকরা এমনও কিছু কিছু জীবের সন্ধান পেয়েছেন, যারা বায়োলুমিনেসেন্সকে কাজে লাগিয়ে নিজের দেহের রঙ পরিবর্তন করে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে পারে। ঠিক গিরগিটির মত! উপযুক্ত পরিবেশ অনুযায়ী নিজের রঙ বদলে ফেলে স্রেফ পরিবেশের মধ্যে মিশে যাওয়া!
তিন নম্বর কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন যৌনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বায়োলুমিনেসেন্সের একটা ভূমিকা রয়েছে। ক্যারিবিয়ান সাগরে প্রাপ্ত অস্ট্রাকড নামক প্রজাতির পুরুষ প্রাণীটি প্রজননের সময় ঊর্ধ্বওষ্ঠ থেকে এক ধরনের বায়োলুমিনেসেন্ট সংকেত নির্গমণ করতে থাকে, যা তার মহিলা সঙ্গীকে তার দিকে আকর্ষণ করে। আবার ওডোন্টোসাইলিস প্রজাতির মহিলা সদস্যরা পুরুষদের আকর্ষণ করতে নিজের দেহে প্রতিপ্রভার সূচনা করে। প্রজনন ঋতু চলাকালীন এই মহিলারা পুরুষদের চারপাশে বৃত্তাকারে পাক খেতে খেতে প্রতিপ্রভা প্রদর্শন করে। (প্রসঙ্গত, এই ওডোন্টোসাইলিস প্রাণীর প্রতিপ্রভা লক্ষ্য করে এগোতে এগোতে নিকোলাস কলোম্বাসের কাছে এক নতুন দুনিয়ার দরজা খুলে যায়।)
প্রতিপ্রভা প্রদর্শনের এরকম আরেকটি কারণ হল সমুদ্রের অভ্যন্তরীণ পরিবেশের আচমকা পরিবর্তন। সমুদ্রের তলায় কোনো কারণে লবণতার পরিমাণ কমে গেলে কিছু কিছু বায়োলুমিনেসেন্ট শৈবাল আছে যারা ক্ষণস্থায়ী গোলাপী ও সবুজ আলো বিচ্ছুরণ করে। এছাড়া সমুদ্রবিজ্ঞানীরা এমন এক ধরনের প্রতিপ্রভ ব্যাকটেরিয়ার খোঁজ পেয়েছেন, সামুদ্রিক লবণতার পরিবর্তনে যারা নিরবচ্ছিন্ন প্রতিপ্রভা প্রদর্শন করে। এরকম লক্ষাধিক ব্যাকটেরিয়া একই জায়গায় উজ্জ্বলভাবে প্রতিপ্রভা দেখালে তাকে বিজ্ঞানের ভাষায় ‘মিল্কি সি’ বলা হয়। এই মিল্কি সি-র ঔজ্জ্বল্য এতটাই তীব্র হয় যে উপগ্রহ মানচিত্রেও মিল্কি সি-র উজ্জ্বল উপস্থিতি দেখা যায়। ভারত মহাসাগরের মত অন্যান্য ক্রান্তীয় মহাসাগরে এর প্রভাব বেশি লক্ষ্য করা যায়।
শহুরে পরিবেশে বড়ো হলেও আজও আমরা রাতের দিকে খোলা মাঠে বসে অবাধ্য জোনাকিদের ডানা ঝাপটানো উপভোগ করি। সমুদ্রের নীচে নানা রঙের আভা ছড়িয়ে রঙিন জেলিফিশগুলি কীভাবে ছুটে যাচ্ছে, আজও আমরা জ্বলজ্বলে চোখে দেখি। এই বায়োলুমিনেসেন্সকে ব্যবহার করে মানবিক জীবনে অনেক সুফলও পাওয়া গেছে। একধরনের বিশেষ বায়োলুমিনেসেন্স প্রাণীর দেহনিঃসৃত পদার্থ থেকে তৈরি করা হয়েছে গ্রিন ফ্লুরোসেন্ট প্রোটিন (GFP), যা জিনগত গবেষণার ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি উপাদান। এই প্রোটিনকে কাজে লাগিয়ে গবেষকরা মানব জিনের কোনো একটি অংশকে চিনতে এবং সেই অংশের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন। এছাড়া প্রতিপ্রভার ধর্মকে কাজে লাগিয়ে উৎসবের মরশুমে একাধিক দেশে বাড়িঘর বা গাছপালা সাজানোর আলোও বানানো হয়েছে। ফলে এগুলি সেই সব দেশের জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে ব্যবহার করা গেছে।
প্রতিরক্ষা থেকে প্রজনন– একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য সামুদ্রিক জীবগুলি কীভাবে বায়োলুমিনেসেন্সকে কাজে লাগায় সে বিষয়ে তাই এখনও বিশ্বজুড়ে গবেষণা চলছে। নিত্যনতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে বায়োলুমিনিসেন্সের আণবিক এবং রাসায়নিক ভিত্তি, এর শারীরবৃত্তীয় নিয়ন্ত্রণ এবং সামুদ্রিক সম্প্রদায়ভুক্ত প্রাণীদেহে এর তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা এখনও চলছে। তাই আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বায়োলুমিনেসেন্ট জীবগুলি গবেষণা ক্ষেত্রের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।
তথ্যসূত্র:






.jpeg)

3 মন্তব্যসমূহ
সমৃদ্ধ হলাম, অনেক কিছু অজানা জিনিস জানতে পারলাম। অসাধারণ বিজ্ঞানসম্মত লেখনী ক্ষমতার প্রকাশ ঘটেছে আপনার এই ভাবনায়। আরও এমনই সুন্দর ব্লগের অপেক্ষায় রইলাম।
উত্তরমুছুনঅসংখ্য ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান মন্তব্যের জন্য।
উত্তরমুছুনOsadharon Mr. Sarthak👍🏻
উত্তরমুছুন