‘ঢাকের তালে কোমর দোলে / খুশিতে নাচে মন / আজ বাজা কাঁসর, জমা আসর / থাকবে মা আর কতক্ষণ’– দশমীটা কাটলেই ঠিক বিসর্জনের মুহূর্তে এই গানটা বাজা চাইই চাই! সত্যি। বাঙালির কাছে পুজো মানেই নতুন জামা, প্যান্ডেল ঘোরা, খাওয়াদাওয়া আর পূজাবার্ষিকীর গল্প-উপন্যাস বাদ দিয়ে যেটা সবথেকে দরকারি, তা হল পুজোর গান। আজকাল গানা বা স্পটিফাইয়ের যুগে বাসে-মেট্রোয় আমরা যতই ইয়ারফোন গুঁজে চলি না কেন, পুজোর বিকেলটা পাড়ার মাইকে পুরোনো দিনের গান শোনার আনন্দটাই আলাদা।
আজ থেকে প্রায় ১০৮ বছর আগে ১৯১৪ সালের শারদীয়া উপলক্ষে প্রথম পুজোর গান প্রকাশিত হয় গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে। গ্রামোফোন কোম্পানি তখন বিদেশি কোম্পানী। ‘শারদীয়া’ নাম দিয়ে সে বছর প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭টি রেকর্ড। শিল্পী তালিকায় ছিলেন মানদাসুন্দরী, কৃষ্ণভামিনী, কে মল্লিক, অমলা দাসের মত ডাকসাইটে শিল্পীরা। এরপর প্রথম স্বদেশী মিউজিক কোম্পানি হিসেবে হিন্দুস্থান রেকর্ডস আত্মপ্রকাশ করে ১৯৩২-এ। কোম্পানির প্রথম পুজোর গানের রেকর্ডে শিল্পী তালিকায় ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এছাড়া ছিলেন অতুল প্রসাদ সেন, রেনুকা দাশগুপ্ত, অনুপম ঘটকের মতো শিল্পীরাও।
সম্ভবত কাজি নজরুলের গানের প্রথম রেকর্ডটি বেরোয় ১৯২৫ সালের পুজোয়– হরেন্দ্র নাথ দত্তের কন্ঠে ‘জাতের নামে বজ্জাতি’। এর পরে নজরুলের অনেক গানই পুজোর সময় প্রকাশিত হয়েছে। যেগুলি গেয়েছেন আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, ধীরেন্দ্র নাথ দাস, হরি মতী, মৃণাল কান্তি দাস, যূথিকা রায়, জ্ঞানেন্দ্র নাথ গোস্বামী প্রমুখ।
ধীরে ধীরে সঙ্গীতের ঘরানা বদলাতে থাকে। সেই সঙ্গে শারদীয়াতে গান করাটা একটা প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। একে একে রেকর্ড হতে থাকল কে এল সায়গল, গৌরীকেদার ভট্টাচার্য, কৃষ্ণচন্দ্র দে-র মতো শিল্পীদের গান এবং সে গানও হল সুপারহিট। ১৯১৭ সালের শারদীয় রেকর্ড মারফত বাংলা গানে কৃষ্ণচন্দ্র দে বা কানাকেষ্ট-এর প্রথম আত্মপ্রকাশ। সেই সময়েই গ্রামোফোন কোম্পানি রেকর্ড বিক্রি বাড়ানোর জন্য প্রকাশিত গানের কথাসহ ‘শারদীয়া’ নামে একটি ছোটো পুস্তিকা প্রকাশ করা শুরু করে। রেকর্ড কেনার সময় ক্রেতা রেকর্ডের সঙ্গে এই বইটি ফ্রি কপি হিসাবে পেতেন।
১৯৪৯ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম পুজোর গান সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা অবলম্বনে সলিল চৌধুরী সুরারোপিত ‘রানার’ গানটি। “রানার! গ্রামের রানার! / সময় হয়েছে নতুন খবর আনার।” ১৯৫০ সালে যূথিকা রায় পুজোয় রেকর্ড করলেন ‘এমনি বরষা ছিল সেদিন’ এবং সেই বছর গানটি হেমন্তবাবুর গাওয়া ‘অবাক পৃথিবী’-র পাশাপাশি একেবারে সুপারহিট। ১৯৫৩ সাল নাগাদ এইচ এম ভি তাঁদের পূর্ব প্রকাশিত ‘শারদীয়া’ বইটি আমূল বদলে দিল এবং নতুন নাম হল ‘এইচ এম ভি শারদ অর্ঘ্য’। মূল্য ৩ আনা। ঠিক এই সময় ‘হায় হায় গো রাত যায় গো’ এবং ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল’– গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখায় প্রবোধচন্দ্র দে (মান্না দে) প্রথম বাংলা গানে প্রবেশ করলেন।
১৯৫৩ তে গীতা দত্ত গাইলেন কানু ঘোষের সুরে ‘আয় আয় রে ছুটে’। ১৯৫৭ সালের পুজোয় প্রকাশিত হয় মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’ গানটি। শ্যামল গুপ্তের কথায় মানবেন্দ্র এই গানের সুর করেন। ১৯৬৫ সাল নাগাদ গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরোধে মঞ্চে নামলেন রাহুলদেব বর্মন। সুরারোপ করলেন পুজোর দুটি গানে: ‘আমি বলি তোমায় দূরে থাকো তুমি কথা রাখো না’ এবং ‘আমার মালতীলতা কি আবেশে দোলে’। গানদুটি গাইলেন লতা মঙ্গেশকর। এরপর প্রায় প্রতি বছর রাহুল-আশা জুটি পুজোর গানে সাড়া ফেলে দেয়। ১৯৬৭ সাল নাগাদ প্রথম কিশোর কুমারকে দিয়ে পুজোর বাংলা গান গাওয়ালেন রাহুলদেব। গীতিকার মুকুল দত্তের কথায় কিশোর গাইলেন ‘একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে’।
১৯৭৬ সালের এইচ এম ভি-এর অপর একটি কালজয়ী শারদ অর্ঘ্য ‘আয় খুকু আয়’। পুলক বন্দোপাধ্যায়ের লেখনী ও ভি বালসারার অপূর্ব সুরসৃষ্টিতে এই গানটিতে গলা মেলান হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদার। এর কয়েকবছর পর পুলকবাবু সৃষ্টি করলেন মা ও মেয়ের মিষ্টি সম্পর্কের আর একটি গান, ‘তুমি আমার মা আমি তোমার মেয়ে’, কণ্ঠে গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আর শ্রাবন্তী মজুমদার।
১৯৭২ সালে সুরকার শৈলেন মুখোপাধ্যায় প্রথম হৈমন্তী শুক্লাকে দিয়ে গাওয়ালেন ‘এত কান্না নয় আমার’ এবং ‘ময়ূর নাচে দেখবি আয়’। হিন্দুস্থান কোম্পানি থেকে রেকর্ড বেরনোর কিছুদিন পরেই ডাক এল এইচ এম ভি থেকে। এরপর পুজোর মরশুমে প্রায় প্রতি বছর হৈমন্তীর কণ্ঠে বাঙালি শুনেছে একের পর এক হিট গান– ‘আমার বলার কিছু ছিল না’, ‘নয়নে আবির ছড়ালে’, ‘ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না’ ইত্যাদি।
উৎসবের দিনগুলো রেকর্ড কোম্পানির কাছে ব্যবসার মরশুমও বটে। শ্রোতাদের চাহিদা, রুচি পরিবর্তন, সুরের ফ্যাশন, বাণীর বৈচিত্র্য– এ সব নিয়ে ক্রমান্বয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার একটাই লক্ষ্য, কী করে একটা ‘হিট’ গান সৃষ্টি করা যায়?
বিশ ও তিরিশের দশকে পুজোর সময় প্রকাশিত গানে পাওয়া গেল অবিস্মরণীয় কিছু শিল্পী। যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম আশ্চর্যময়ী দাসী, আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, কৃষ্ণচন্দ্র দে, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, কমল ঝরিয়া ইত্যাদি। ১৯১৭ সালেই পুজোর গানে কৃষ্ণচন্দ্র দে রেকর্ড করেন ‘আর চলে না মা’ ও ‘মা তোর মুখ দেখে কি’। ১৯৩৫-এর পুজোয় ‘সখী লোকে বলে কালো’ ও ‘আমি চন্দন হইয়ে’, ১৯৩৯-এ ‘স্বপন দেখিছে রাধারানি’ ও ‘হিয়ায় রাখিতে সে পরশমণি’ তাঁর উল্লেখযোগ্য পুজোর গান। ১৯২৩-এ ইন্দুবালার পুজোর রেকর্ড ‘তুমি এস হে’ (ইমন) ও ‘ওরে মাঝি তরী হেথায় বাঁধব না’ (জংলা) দারুন হিট করেছিল। আঙ্গুরবালার ১৯২২-এর পুজোয় ‘কত আশা করে তোমারি দুয়ারে’ ও ‘আমার আমায় বলিতে কে আর’ ভক্তিগীতি হলেও খুব জনপ্রিয় হয়। কমল ঝরিয়া প্রথম রেকর্ড করেন ১৯৩০-এর পুজোতে, ‘প্রিয় যেন প্রেম ভুলো না’ (গজল) ও ‘নিঠুর নয়নবান কেন হান’ (দাদরা)।
দেশাত্মবোধক গানও তখন পুজোর গানের রেকর্ডে জায়গা পেত। ১৯৩৮ সালের পুজোয় দিলীপকুমার রায় রেকর্ড করেন ‘বন্দেমাতরম’ ও ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা’, ১৯৪৭ সালের পুজোয় করেন ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ ও ‘ধাও ধাও সমরক্ষেত্রে’। ১৯২৫-এর পুজোয় নজরুলের গানের কথা তো শুরুতেই বললাম। এর আগেও ১৯২২-এর পুজোতে প্রকাশিত হয় ‘সেকালের বাংলা’, ‘চরকার গান’ও ‘দেশ দেশ নন্দিত করি’। দিলীপ কুমার রায়ের পুজোর গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল আগেই; ১৯২৫ সালে ‘ছিল বসি সে কুসুমকাননে’ (কীর্তন) ও ‘রাঙ্গাজবা কে দিল তোর পায়ে’ (মিশ্র সিন্ধু), গান দু’টির রেকর্ড উল্লেখযোগ্য। দিলীপ কুমার রায়ের গানের প্রসঙ্গে আরেকটি নাম এসেই পড়ে; তিনি উমা বসু। দিলীপ কুমারের কথা ও সুরে ১৯৩৯ সালে উমা বসুর পুজোর গান ‘জীবনে মরণে এস’ সুপারহিট। সে কালে পুজোর গানে অন্যান্য গানের মতোই রেকর্ড হত অতুলপ্রসাদ সেনের গানও। ১৯২৫-এর পুজোয় বিখ্যাত শিল্পী সাহানা দেবীর গাওয়া ‘কত গান তো গাওয়া হল’ ও ‘শুধু দুদিনেরই খেলা’ জনপ্রিয় হয়েছিল। বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কনক দাস ১৯৩২-এ পুজোর গানে রেকর্ড করেন অতুলপ্রসাদের দু’টি গান।
’৮০ এর দশকের শুরু সময় থেকে রেকর্ডের জায়গা দখল করে বসল ক্যাসেট। অলিতে-গলিতে বিভিন্ন ক্যাসেট কোম্পানি গজিয়ে উঠতে লাগল। সামান্য কিছু অর্থের আশায় ক্যাসেট নকল করাও শুরু হয়। ১৯৮৮ সাল নাগাদ এইচ এম ভি তাদের শেষ ‘শারদ অর্ঘ্য’ পত্রিকা প্রকাশ করে। ব্যাক-কভারে লেখা ছিল “সংগীত বাঁচান, নকল হটান”। নয়ের দশকের শুরুর দিকে আবির্ভাব হয় জনপ্রিয় শিল্পী কুমার শানুর (কেদারনাথ ভট্টাচার্য), তাঁর ‘সুরের রজনীগন্ধা’, ‘প্রিয়তমা মনে রেখো’ ইত্যাদি অ্যালব্যামের মাধ্যমে।
এরপর নয়ের দশকের শেষে আরো উন্নত রেকর্ডিং সিস্টেম বাজারে আসতে শুরু করে। তখন সদ্য সদ্য কম্পিউটারের প্রচলন শুরু হচ্ছে। মিউজিক কোম্পানিগুলি এই সময় ডিজিটাল পদ্ধতিতে রেকর্ড করে কম্প্যাক্ট ডিস্ক আকারে অ্যালবাম বের করতে শুরু করে। এই সময় ইন্দ্রনীল সেনের ‘দূরের বলাকা’ সিরিজ, শ্রীকান্ত আচার্যের ‘মনের জানালা’, ‘বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’ এবং সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ‘তোমাকে চাই’ তরুণদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর একে-একে নতুন ধরনের গান নিয়ে পুজোর বাজার গরম করতে আসেন নচিকেতা চক্রবর্তী, অঞ্জন দত্ত, শিলাজিৎ, রূপম ইসলাম ও আরও প্রতিভাবান কিছু তরুণ তুর্কির দল। জন্ম হয় বাংলা ব্যান্ডের। সেই সময়ে কলকাতার মিডিয়া এইসব গানগুলোর মাথায় ‘জীবনমুখী’ তকমা লাগিয়ে দেয়।
এরপর সময়ের চাকা গড়ায় আরও কিছুটা। বাজারে আসে পেনড্রাইভ, ক্লাউড স্টোরেজ, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মত নিত্যনতুন প্রযুক্তি। শিল্পীরাও নিজস্ব ডিজিট্যাল প্ল্যাটফর্মে বা ইউটিউবে মেলে ধরেন নতুন নতুন গানের পসরা। এখন আর আগের মত ‘চাঁদের হাট’ খুব একটা দেখা যায় না। প্রতি বছরই নতুন নতুন পুজোর গান তৈরী হয় ঠিকই, কিন্তু এমন কিছু গান আছে যা প্রতি বছরই ফিরে ফিরে আসে কালজয়ী গান হয়ে। আমার ধারণা জগতে সঙ্গীত যতদিন আছে, বাঙালির সঙ্গীত পিপাসা যতদিন আছে, ততদিন পুজোর গানের প্রতি আমাদের এই দুর্বলতা থেকে যাবে। গান শোনার মাধ্যম বদলালেও থেকে যাবে এই সঙ্গীতপ্রেম।
তথ্যসূত্র:
পুজোর গানে আজও আছে, সঙ্কর্ষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, আজকাল, ৫ অক্টোবর ২০১৯।

2 মন্তব্যসমূহ
বাহ্ দারুণ লেখা
উত্তরমুছুনOsadharon hoyeche apnar lekhata👍🏻
উত্তরমুছুন