চার্লস রবার্ট ডারউইন তখন ২৩ বছরের তরতাজা যুবক। এইচ.এম.এস. বিগলে চেপে রওনা দিয়েছেন তাঁর অদৃষ্টের উদ্দেশ্যে। জাহাজে বসেই ডায়েরির পাতায় গোটা ঘটনার বিবরণ লিখে রাখছেন তিনি। একদিন সকালে এক অদ্ভুত ঘটনা দেখে ডায়েরির পাতায় তিনি লিখলেন– “Inundated by ballooning spiders on a relatively, calm, clear day.”

সালটা ১৮৩২। ডারউইনদের জাহাজ এইচ.এম.এস. বিগল তখন আর্জেন্টিনার উপকূল থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে। এরকমই একদিন সকালে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে ডারউইন লক্ষ্য করেছিলেন ছোটো ছোটো কিছু মাকড়সার অদ্ভুত আচরণকে। জাহাজের ডেক তখন কয়েকশো ছোটো ছোটো লাল মাকড়সায় ছেয়ে গেছে। ডারউইন অবাক হয়ে ভাবলেন– উপকূল থেকে এত দূরে থাকা সত্ত্বেও জাহাজের ডেকে এরা এল কীভাবে? মাকড়সার তো ডানা নেই যে তারা উড়ে উড়ে চলে আসবে।

ডারউইনের ডায়েরি পড়লে জানা যায় এই ‘উড়ন্ত’ মাকড়সার কোনো ব্যাখ্যা তিনি খুঁজে পাননি। ডায়েরিতে তিনি লিখে গেছেন– “এই মাকড়সাগুলি একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পেট উঁচিয়ে ধরে। হাওয়ার দাপটে তাদের শরীর থেকে বের হয় মিহি রেশমি সুতোর মতো জিনিস। সেগুলোই হাওয়ায় ভাসে, আর তারপর সেই সুতো ধরে আকাশে লাফ দেয় তারা।” রহস্যটা কিন্তু অন্য জায়গায়। হাওয়ার দাপটেই যদি শরীর থেকে রেশমি সুতো বেরিয়ে আসবে, তাহলে তো প্রবল বাতাসে এই পদ্ধতি বেশি করে কাজে লাগবার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, হালকা বাতাসেও মাকড়সাগুলি একই পদ্ধতি অনুসরণ করে লাফ দিতে পারছে। ডারউইন তখন ভাবতে শুরু করলেন, তাহলে কি এর পেছনে কাজে করছে অন্য কোনো কারণ?

ডারউইনের মৃত্যুর পরেও বেশ অনেক বছর এই প্রশ্নের উত্তর অধরাই থেকে গিয়েছিল। অবশেষে আশার আলো খুঁজে পান ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক এরিকা মোর্লি ও ড্যানিয়েল রবার্ট। কারেন্ট বায়োলজি জার্নালে তাঁরা যে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন তাতে তাঁরা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, উড়ন্ত মাকড়সার এই ধরনের আচরণের জন্য দায়ী বায়ুমণ্ডলের বৈদ্যুতিক চরিত্র।

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল যে বৈদ্যুতিকভাবে সক্রিয় তা একেবারেই নতুন কথা নয়। সেই ছোটোবেলায় স্কুলের বইতে বিদ্যুৎ চমকানোর জন্য দায়ী পজিটিভ ও নেগেটিভ চার্জের কথা আমরা সকলেই পড়েছি। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই উড়ন্ত মাকড়সাগুলি বাতাসের এই বৈদ্যুতিক চরিত্র অনুভব করতে পারে।

এদের শরীর থেকে যখন রেশমি সুতো বেরোয়, তখন সেই সুতোয় থাকে নেগেটিভ চার্জ। মাকড়সাগুলো যেখানে বসে থাকে, সেখানকার মাটিতেও থাকে এই একই নেগেটিভ চার্জ। ফলে এই দুই নেগেটিভ চার্জ পরস্পরকে বিকর্ষণ করে পরস্পরের থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এই বিকর্ষণের ফলে সুতোগুলো অনেক দূর পর্যন্ত হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, এই মাকড়সাগুলো যখন গাছের ডালে বাসা বাঁধে, অথবা ঘাসের ডগাতে চড়ে বসে, তখনও এই একই ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। গাছপালাগুলো সবই মাটির সঙ্গে লাগানো থাকে বলে আর্থিংয়ের কারণে এগুলোর সবেতেই থাকে সেই নেগেটিভ চার্জ। উল্টোদিকে, গাছের ডালপালাগুলো উঁচু এবং ছড়ানো-ছেটানো থাকে বলে তার চারিদিকে থাকে বাতাসের পজিটিভ চার্জ। দুয়ে মিলে রেশমি সুতোগুলো নিমেষের মধ্যে উঠে যায় ওপরে, যা বেয়ে মাকড়সাগুলো অনায়াসে বাতাসের মধ্যে দিয়ে পাড়ি জমাতে পারে। দূর থেকে এই দৃশ্য এমনই অভাবনীয় দেখতে লাগে যে কেউ কেউ এই ঘটনাকে ‘বেলুনিং স্পাইডার’ বলেও উল্লেখ করেন।

বেলুনিং স্পাইডার

২০১৮ তে মোর্লি ও রবার্ট এই একই ঘটনাটি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করে দেখান। তার বছর পাঁচেক আগে অবশ্য পিটার গরহ্যাম নামে এক বিজ্ঞানী অনুরূপ ঘটনাকে কিছুটা আন্দাজ করে, আর কিছুটা বিজ্ঞান মিশিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখে ফেলেছিলেন। তিনি একটি গাণিতিক মডেল আবিষ্কার করে দেখান বাতাসের গতিবেগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মাকড়সাগুলি নাকি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪.৫ কিলোমিটার পর্যন্ত উঠে যেতে পারে।

মোর্লি ও রবার্ট তাঁদের পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করেছিলেন সামান্য একটি প্লাস্টিকের বাক্স। তার মধ্যে কয়েক চিলতে কার্ডবোর্ডের টুকরো রেখে তার মধ্যে বসিয়ে দেন কয়েকটি মাকড়সা। এরপর কৃত্রিম প্রযুক্তির মাধ্যমে বাক্সের মধ্যে সৃষ্টি করেন মৃদু ইলেকট্রিক ফিল্ড। এর প্রায় কয়েক মিনিট বাদে তাঁরা লক্ষ্য করলেন মাকড়সাগুলির পায়ে থাকা সূক্ষ্ম রোঁয়াগুলি হালকা হালকা নড়তে শুরু করেছে। চার্জযুক্ত চিরুনির কাছে কোনো কাগজের টুকরো আনলে যেমন তা নড়াচড়া করে, অবিকল সেরকম। এর কিছুক্ষণ পর দেখা গেল মাকড়সাগুলি পায়ের ডগার ওপর ভর করে আকাশের দিকে পেট উঁচিয়ে দাঁড়াচ্ছে। ঠিক যেমনটা লক্ষ্য করেছিলেন চার্লস ডারউইন।

এই ঘটনা প্রমাণ করে যে এই মাকড়সাগুলি তাদের চারপাশের বৈদ্যুতিক পরিবেশ টের পায়। এই ঘটনার সত্যতা প্রমাণের জন্য বিজ্ঞানীরা তাঁদের পরীক্ষার দ্বিতীয় ধাপে সুইচ অফ্ করে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রটি নিষ্ক্রিয় করে দেন। প্রত্যাশিতভাবেই, মাকড়সাদের উড়ানও এরপরেই বন্ধ হয়ে যায়।

মোর্লি ও রবার্টের পরীক্ষা (https://doi.org/10.1016/j.cub.2018.05.057 থেকে প্রাপ্ত)

মোর্লি ও রবার্টের পরীক্ষা বিজ্ঞানীমহলে আলোড়ন ফেলে দিলেও এ বিষয়ে গবেষণা কিন্তু একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি। মাকড়সাগুলি কীভাবে তাদের চারপাশের বৈদ্যুতিক পরিবেশের খবর পায় সে তথ্য এখনও আমাদের কাছে অজানা। শুধু তাই নয়, মাকড়সাগুলির ওপর বাতাসের প্রভাব নিয়েও ভাবনার অবকাশ রয়েছে। এর মধ্যে আবার বার্লিনের টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এরোডাইনামিক বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার মুনসুং চো দেখেছেন, ওড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে মাকড়সাগুলি তাদের সামনের পা তুলে রাখে খানিকক্ষণ। সেটা কি আদপে বাতাসের গতিবেগ মাপার জন্য? এর উত্তর যদিও জানা যায় না। কে বলতে পারে, অদূর ভবিষ্যতে হয়ত আমরা পেতে পারি নতুন কোনো তথ্য।

তথ্যসূত্র:

Cho M, Neubauer P, Fahrenson C, Rechenberg I (2018) An observational study of ballooning in large spiders: Nanoscale multifibers enable large spiders’ soaring flight. PLoS Biol 16(6): e2004405. https://doi.org/10.1371/journal.pbio.2004405
Morley, E. L., & Robert, D. (2018). Electric Fields Elicit Ballooning in Spiders. Current biology : 28(14), 2324–2330.e2. https://doi.org/10.1016/j.cub.2018.05.057
Mystery of Charles Darwin's flying spiders solved - they harness electricity, Sarah Knapton, The Telegraph, 5 July, 2018.
দে উড়ান, বিমান নাথ, সংবাদ প্রতিদিন, ২৪ এপ্রিল, ২০২২।
Flying spiders sense meteorological conditions, use nanoscale fibers to float on the wind.
মাকড়সা কীভাবে ওড়ে?