সুর। অব্যর্থ যন্ত্রণা নিরাময়ে বহুল ব্যবহৃত এক প্রক্রিয়া। মন খারাপ, উদাসীনতা, ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ– সব কিছুর অব্যর্থ দাওয়াই এই ‘গান’। এটা কেবল কথার কথা নয়, বরং রয়েছে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি। বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক বহুল প্রচলিত ধারা হল সঙ্গীতের ব্যবহারে রোগ নিরাময়। বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘মিউজিক থেরাপি’। কেবল মানসিক রোগ নয়, বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, শারীরিক নানা ব্যাধিও নিরাময় হয় এই থেরাপিতে।
“একটা ভালো গান শোন। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।” যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য তো বটেই, এমনকি শিশুদের ক্ষেত্রেও মিউজিক থেরাপির সুফল হাতেনাতে পাওয়া গেছে। একটি সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী, ৫-৮ বছর বয়সী শিশুদের হাতে ইন্ট্রাভেনাস ক্যানুলা করতে গিয়ে যেসব শিশুদের মিউজিক থেরাপি দেওয়া হয়েছিল, তারা অন্যান্যদের তুলনায় অনেক কম ব্যথা অনুভব করতে পেরেছে। যদিও মিউজিক থেরাপির ধারণাটা তুলনামূলকভাবে নতুন, কিন্তু সত্যি বলতে মিউজিক অর্থাৎ সঙ্গীতের সঙ্গে থেরাপির সম্পর্কটা কিন্তু একেবারেই নতুন নয়।
পশ্চিমা সংস্কৃতির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, যিশুখ্রিস্টের জন্মের বহু শতাব্দী আগে থেকেই চিকিৎসাশাস্ত্রে সঙ্গীত ব্যবহার করার রীতি প্রচলিত হয়েছে। গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী, অ্যাপোলোকে সঙ্গীতের দেবতা হিসেবে মান্য করা হয়। এমনকি এও বিশ্বাস করা হয় যে অ্যাপোলোর পুত্র এসকুলাপিয়াস সুর ও সঙ্গীত সৃষ্টি করে মানুষের রোগ নিরাময় করতে পারেন। এছাড়া পুরোনো পুঁথিপত্র ঘাঁটলে বোঝা যায়, ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ বা তারও আগে মিশরীয় যাজক-চিকিৎসকরা রোগ নিরাময়ের জন্য সঙ্গীতের সাহায্য নিয়েছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের তাবড় তাবড় দার্শনিকবিদ, যথা প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হিপোক্রেটিস, কর্নেলিয়াস সেলসাসরাও শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য মিউজিক থেরাপির পরামর্শ দিয়ে গেছেন। বাইবেলেও একটি দৃশ্যে থেরাপি হিসেবে সঙ্গীতের কথা বলা রয়েছে, যেখানে প্রেতাত্মার হাত থেকে রাজা শৌলকে মুক্ত করার জন্য ডেভিড প্রাণপণ বীণা বাজিয়েছিলেন। এছাড়া রবার্ট বার্টনও সপ্তদশ শতাব্দীতে তার ক্লাসিক রচনা, দ্য অ্যানাটমি অফ মেলানকোলিতে লিখেছেন যে, “...music and dance were critical in treating mental illness, especially melancholia.”
পুরোনো বইপত্তর নিয়ে যাঁদের ঘাঁটাঘাঁটির অভ্যেস আছে, তাঁরা নিশ্চই জানবেন যে এই সঙ্গীত বিষয়ে চর্চা এবং সর্বোপরি শারীরবৃত্তীয় কাজে মানবদেহের ওপর সঙ্গীতের প্রভাব সম্পর্কিত একাধিক প্রাচীন বই রয়েছে। ১৬৫০ সালে অ্যাথানাসিয়াস কির্চারের লেখা ‘মুসুর্গিয়া ইউনিভার্সালিস’, ১৭১৪ সালে মাইকেল আর্নস্ট এটমুলারের লেখা ‘ডিসপুটেটিও ইফেক্টাস মিউজিক ইন হোমিনেম’ (মানুষের উপর সঙ্গীতের প্রভাব বিষয়ক বিতর্ক), ১৭৪৫ এ আর্নস্ট আন্তন নিকোলাইয়ের লেখা ‘ডাই ভারবিন্ডুং ডার মিউজিক মিট ডের আরজনিগেলাহরিট’ (সঙ্গীতের সঙ্গে মেডিসিনের সম্পর্ক) অথবা ১৭৪৯ এ রিচার্ড ব্রকলসবির লেখা ‘রিফ্লেকশন্স অফ অ্যান্সিয়েন্ট অ্যান্ড মডার্ন মিউজিক’– এই সব বইগুলি পড়লে বোঝা যায় মিউজিক থেরাপির ধারণাটা কত প্রাচীন। উনবিংশ শতাব্দী জুড়ে, ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকদের দ্বারা প্রচুর বই এবং নিবন্ধ লেখা হয়েছে যাতে রোগীর মানসিক এবং শারীরিক চিকিৎসার জন্য থেরাপিউটিক এজেন্ট হিসাবে সঙ্গীতের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা রয়েছে।
পশ্চিমা জগৎ থেকে ফিরে যদি ভারতের দিকে তাকাই, তাহলেও দেখতে পাব মিউজিক থেরাপির এক অপূর্ব নিদর্শন। কথিত আছে, একবার নাকি সম্রাট আকবরের হস্তিশালায় এক উন্মত্ত হাতি ঊচ্ছৃঙ্খল আচরণ শুরু করে। তখন সেখানে উপস্থিত হন নবরত্ন সভার সঙ্গীতজ্ঞ তানসেন। সুরের মূর্ছনায় হাতিটিকে শান্ত করেন তিনি। প্রকৃতির সঙ্গে সুরের বন্ধনে এভাবেই নিজেকে বেঁধেছিলেন তানসেন। কেউ কেউ বলতেন, বাহার রাগের মাধ্যমে গাছে নাকি ফুল ফোটাতে পারতেন তানসেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও মিউজিক থেরাপির ইতিহাস যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই কাহিনি।
তবে বর্তমানে মিউজিক থেরাপির যে রূপ আমরা দেখি, তার সূচনা বোধহয় অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে। মনোবিদ থায়ার গ্যাস্টন আমেরিকা জুড়ে পেশা হিসেবে মিউজিক থেরাপির উন্নতিতে অনেক সাহায্য করেছিলেন। এই কারণে তাঁকে ‘মিউজিক থেরাপির জনক’ বলা হয়। থায়ার গ্যাস্টন ছাড়াও আমেরিকান থেরাপিস্ট ইরা আল্টশুলার এবং বিখ্যাত গবেষক উইলিইয়াম ভ্যানডারওয়াল সর্বপ্রথম সরকারী প্রতিষ্ঠানে সংগীত থেরাপি ব্যবহার করা শুরু করেন। এরপর মিশিগান, ক্যানসাস বা শিকাগোর মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ১৯৪০ এর মাঝামাঝি সময় থেকে সংগীতবিদ্যার ওপর বিভিন্ন কোর্স পড়াতে শুরু করে।
কীভাবে হয় এই মিউজিক থেরাপি? সঙ্গীতের মতোই শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আলাদা সুর, ছন্দ, তাল, লয় রয়েছে। পছন্দের সঙ্গীত বা সুর প্রভাব ফেলে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে। এটি সব আবেগের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। পছন্দের গান তথা শ্রুতিমধুর শব্দে তারা উদ্দীপিত হয়। স্নায়ুতন্ত্রকেও উজ্জীবিত করে সঙ্গীত। তবে মিউজিক থেরাপি বলতে হেডফোনে গান শোনা বোঝায় না। বরং লঘু সুরের গান বা মিউজিক ছোট বক্সে চালিয়ে শোনানো হয় রোগীকে। সেতার, সরোদ, ভায়োলিনের মতো বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েও শোনানো হয়। রোগীর সংস্কৃতি, পরিপার্শ্ব, পছন্দ, রুচি, রোগ দেখে সঙ্গীত ও চিকিৎসা প্রক্রিয়া নির্বাচন করেন চিকিৎসক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, এই থেরাপির ফলে রোগী ধীরে ধীরে সুস্থতার দিকে ফিরছেন। যদিও চিকিৎসকরা বলেন, মিউজিক থেরাপি কখনওই একমাত্র সমাধান নয়। যে কোনও রোগের অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতির পাশাপাশি মিউজিক থেরাপি করলে দ্রুত আরোগ্য মেলে মাত্র। কে বলতে পারে, ভবিষ্যতে হয়ত চিরাচরিত মেডিসিনের পাশাপশি মিউজিক থেরাপিও হয়ে উঠবে চিকিৎসা ব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম?
তথ্যসূত্র:
তানসেন এবং উচ্ছৃঙ্খল হাতির গল্প, বর্তমান, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩।
সংগীত থেরাপি: ইতিহাস, সুবিধা, প্রকার, ক্রিয়াকলাপ
Music Therapy | Wikipedia
.jpeg)
0 মন্তব্যসমূহ