বঙ্গরঙ্গালয়ের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রের সম্পর্ক ছিল কিছুটা রহস্যময়, ভালো-মন্দ মেশানো। ছোটবেলায় যাঁর যাত্রা ও কবিগান শেখার শখ ছিল। বন্ধুদের নিয়ে যিনি পাড়ায় কবিগানের দল করেছিলেন– পরিণত বয়সে যাত্রা-থিয়েটারের প্রতি তিনি আগ্রহী হবেন সেটাই স্বাভাবিক। তবে অধ্যাপনা ও সমাজসংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে, তাঁর পক্ষে নিয়মিত নাটক দেখা হয়ত সম্ভব হত না। তা সত্ত্বেও শোনা যায়, সিঁদুরিয়াপটিতে রামগোপাল মল্লিকের বাড়িতে স্থাপিত মেট্রোপলিটন থিয়েটারে ১৮৫৯ সালে তিনি একাধিকবার উমেশচন্দ্র মিত্র রচিত ‘বিধবা-বিবাহ’ নাটক দেখেছিলেন। সেই নাটকে অভিনেতাদের অভিনয় এতটাই মর্মস্পর্শী হয়েছিল যে তিনি নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি।
তাঁর ছাত্র হরিশ্চন্দ্র কবিরত্নের লেখায় উল্লেখ পাওয়া যায়– সংস্কৃত নাটক অভিনয় দেখে তিনি আমোদিত হতেন, নিকটবর্তী বিশ্বাস মহাশয়ের বাড়ি থেকে অলংকার ও বস্ত্র এনে ছাত্রদের সাজাতেন। এর পাশাপশি তাঁর অন্য একজন ছাত্র যোগেন্দ্রনাথ মিত্র আর এক কাহিনির উল্লেখ করেন, যাতে শিক্ষক হিসেবে বিদ্যাসাগরের রক্ষণশীল মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। যোগেন্দ্রনাথ বলছেন, স্কুলে ভোলানাথ বলে তাঁরই একজন সহপাঠীকে বিদ্যাসুন্দর থিয়েটারে ‘বিদ্যা’ এবং রত্নাবলী যাত্রায় ‘সখী’ সাজার অপরাধে স্কুল ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। এ প্রসঙ্গে একটি কথা জানিয়ে রাখা ভালো। যে সময়ের কথা বলছি, তখন বাংলাদেশের সমাজ নারী-স্বাধীনতার প্রতি একেবারেই উদাসীন ছিলেন বলাই বাহুল্য। ভদ্র বাড়ির মেয়েরা মুখে রং মেখে, সঙ সেজে যাত্রাপাড়ায় যাবে– এ ছিল ভাবনার অতীত। ফলে এই সমস্ত বড় বড় থিয়েটারে পুরুষ অভিনেতাদেরই মেয়েমানুষ সেজে মঞ্চে উঠতে হত। সহপাঠী ভোলানাথও সেই ধরনেরই এক পরিস্থিতির শিকার।
সে যাই হোক, এবার আসি অন্য কথায়। সে সময়ের রীতি অনুযায়ী প্রধানত আমন্ত্রিত হয়েই বিদ্যাসাগর শৌখিন দলের নাট্যাভিনয়ে বেশ কয়েকবার দর্শক হিসেবে উপস্থিত থেকেছেন। যদিও সে সময়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ খুব একটা পাওয়া যায় না। যে দুটি অভিনয় দেখার কথা জানা যায়, তাঁর একটি ১৮৫৮ সালের ২২ মার্চ বড়বাজারে গদাধর শেঠের বাড়িতে ‘কুলীন কুলসর্বস্ব’ এবং ঐ বছরেরই ৩১ জুলাই পাইকপাড়ার বেলগাছিয়া নাট্যশালায় ‘রত্নাবলী’ নাটক।
ন্যাশনাল থিয়েটার সংগঠনপর্বে যাঁরা পুরোধা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অমৃতলাল বসুর সঙ্গে বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল বলে জানা যায়। অমৃতলাল যখন কাশীতে ডাক্তার লোকনাথ মৈত্র মহাশয়ের কাছে হোমিওপ্যাথি চর্চার জন্য আশ্রিত আছেন, তখন বিদ্যাসাগর তাঁর পিতৃদেবকে কাশীতে রাখতে যান। তখন গঙ্গার ওপরে সেতু নির্মিত হয়নি বলে, ভোররাতে নৌকাযোগে নদী পার হয়ে বিদ্যাসাগরকে রাজঘাট স্টেশনে পৌঁছানোর দায়িত্ব নিতে হয়েছিল অমৃতলালকে। সতীর্থ বন্ধু মধুসূদন লাহিড়ীর সঙ্গে পরামর্শ করে তাঁরা যাতে ঘুমিয়ে না পড়েন, সেজন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাছে তাঁরা গল্প শোনানোর আব্দার করেন। ছোট বড় বিচিত্র রূপকথায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্গে তাঁরা নিশিযাপন করেন। এরপর প্রায় শেষ রাত্রে অমৃতলাল বিদ্যাসাগরকে রেল স্টেশনে পৌঁছে দিতে সক্ষম হন।
তবে এই গল্পের শেষটা কিন্তু মোটেই সুখকর হয়নি। আশুতোষ দেব, যিনি সেই সময়ে ছাতুবাবু নামে পরিচিত ছিলেন, তাঁর দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ ছাতুবাবুর বাড়ির সামনের মাঠে একটি নতুন ঘরে বেঙ্গল থিয়েটার নামে একটি স্থায়ী রঙ্গালয়গৃহ প্রতিষ্ঠা করেন। তার আগেই অবশ্য শরৎবাবু একটি কমিটি গঠন করেছিলেন যাতে রঙ্গালয় সম্পর্কিত যাবতীয় কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যায়। সমাজের গণ্যমান্য যে কয়েকজন বিদ্বজ্জনকে সমিতির সভ্য করা হয় তাঁদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র দত্ত, বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায়, হরিদাস দাস (‘হরি বৈষ্ণব’), গিরীশচন্দ্র ঘোষ, দেবেন্দ্রনাথ মিত্র, বটু বাবু, প্রিয়নাথ বসু (ছাতুবাবুর ভাগিনেয়) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। রঙ্গমঞ্চটি নির্মিত হয়েছিল লিউইসের লাইসিয়াম থিয়েটারের আদলে। শোনা যায়, এই রঙ্গমঞ্চের গৃহনির্মাণের জন্য নগদ পাঁচ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছিল।
আগেই বলেছি, সে সময়ে পুরুষদেরই মেয়ে সেজে মঞ্চে অভিনয় করতে হত। এবার কেউ কেউ প্রস্তাব দিলেন, পুরুষদের জায়গায় সত্যিকারের মেয়েদের দিয়ে মহিলা চরিত্রে অভিনয় করাতে পারলে অনেক টাকা রোজগার হতে পারে। এ বিষয়ে প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন অবশ্য মাইকেল মধুসূদন। রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার পরেই তিনি সংগঠকদের একত্র করে বলেছিলেন, “তোমরা স্ত্রীলোক লইয়া থিয়েটার খোল; আমি তোমাদের জন্য নাটক রচনা করিয়া দিব; স্ত্রীলোক না লইলে কিছুতেই ভাল হইবে না।” এ বিষয়ে সুলভ সমাচার পত্রিকা (১৫ এপ্রিল, ১৮৭৩) একটি প্রতিবেদনে লেখে: “...তিনি (মধুসূদন) খৃষ্টীয়ান হইয়া বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিয়া যদি এ-প্রকার সাংঘাতিক পরামর্শ দিয়া থাকেন, তাহা হইলে বড় দুঃখের বিষয়। মেয়ে নটী আনিতে গেলে মন্দ স্ত্রীলোক আনিতে হইবে, তাহা হইলে শ্রাদ্ধ অনেকদূর গড়াইবে। …ভদ্র লোকের ছেলে হইয়া এইরূপ জঘন্য ইচ্ছা মনে স্থান দেন ইহাই আশ্চর্য্যের বিষয়। যা হউক, আমরা অনুরোধ করিতেছি যেন এ প্রকার অন্যায় কার্য্যে তাঁহারা প্রবৃত্ত না হন।”
বেঙ্গল থিয়েটারে উপদেষ্টা সমিতির জরুরি সভায় অভিনেত্রী নিযুক্তির পক্ষে সমর্থন জানিয়েছিলেন সত্যব্রত সামশ্রমী ও উমেশচন্দ্র দত্ত। আর গৃহীত সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন বিদ্যাসাগর। শুধু তাই নয়, সেদিনের সভা থেকে বেরিয়ে ক্রোধে-অপমানে তিনি থিয়েটার নিয়ে এতটাই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন যে এরপর থেকে থিয়েটারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক তিনি ছিন্ন করেন। এরপরে প্রায় আঠেরো বছর জীবিত থাকলেও থিয়েটার দেখা তো দূরের কথা, যে পথে রঙ্গালয় আছে সে দিকে ভুলেও পা বাড়াননি। ১৮৮১ সালে ন্যাশনাল থিয়েটারে যখন প্রথম বারের জন্য ‘সীতার বনবাস’ অভিনীত হয়, তখন স্বয়ং গিরীশচন্দ্র ঘোষ বিদ্যাসাগরকে নাটক দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর তা গ্রহণ করেননি। কারণ ছিল একটাই। তিনি সেই সময় সমস্তরকম রঙ্গালয়-সংস্রব থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, অকাল প্রয়াণের কারণে মাইকেল শেষ পর্যন্ত বেঙ্গল থিয়েটারে প্রকৃত অভিনেত্রীদের নিযুক্তি দেখে যেতে পারেননি। যদিও তাঁর ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক অভিনয় দিয়েই বেঙ্গল থিয়েটারের দ্বারোদঘাটন হয়েছিল (১৬ আগস্ট, ১৮৭৩)। সেই সন্ধ্যাতেই, পেশাদার রঙ্গালয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন প্রথম নিয়োগপ্রাপ্তা চার অভিনেত্রী: জগত্তারিণী, গোলাপ (পরবর্তীতে সুকুমারী), এলোকেশী ও শ্যামা। আর প্রত্যাশিতভাবেই বিদ্যাসাগর, যিনি কিনা স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, সেদিনও নাট্যালয়ে বারাঙ্গনা-সংস্রব সম্পর্কে কঠোর অভিমত জানিয়েছিলেন।
বিদ্যাসাগর বিষয়ে প্রচলিত অনেক জনশ্রুতিই সেকালের নাটকে বিবৃত হয়েছে। নাটকের সংলাপের মাধ্যমে, তর্কে-বিতর্কে একটা সামাজিক আন্দোলন কীভাবে বিদ্যাসাগরের ‘কর্ম্মবহুল জীবনের আলেখ্য’ হিসেবে নির্মিত হয়েছে– এবং তা শেষ পর্যন্ত রঙ্গালয়ের পরিসরে কতটা সার্থক হতে পারে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে বাংলা নাটককে উৎসাহ দেওয়ার পেছনে তাঁর এই উদ্যোগ যে দেড়শো বছর পরেও তাঁর স্মরণীয়তার দাবি হারিয়ে ফেলেনি সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
তথ্যসূত্র:
বিদ্যাসাগর-মধুসূদনের বন্ধুত্ব: অতলান্ত সাগরে অমৃতের সম্ভার

1 মন্তব্যসমূহ
খুব ভালো লাগল।
উত্তরমুছুন