বীন্দ্রনাথের সঙ্গে গান্ধীজির, অথবা বলা ভালো গুরুদেবের সঙ্গে মহাত্মার (পরস্পরকে এই সম্বোধনেই ডাকতেন তাঁরা) পারস্পরিক সম্পর্ক মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক বিরল এবং শিক্ষণীয় নিদর্শন। দুজনেই জন্মেছেন একই সময়ে, উনিশ শতকের ছয়ের দশকে; দুজনেই ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেছেন; দুজনের চিন্তাভাবনাই আবার বিশ শতকের পৃথিবীকে তুমুলভাবে প্রভাবিত করেছে।

সালটা ১৯১৪-র মাঝামাঝি। সদ্য ভারতে পাশ হয়েছে Indian’s Relief Act। এরই মধ্যে ভারতের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য ব্রিটিশ সরকার ডেকে পাঠাল গান্ধীজিকে। গান্ধীজি ইংল্যান্ডে চললেন, উদ্দেশ্য দক্ষিণ আফ্রিকার পাশাপাশি ইংল্যান্ডের সব ক’টি উপনিবেশের সমস্যা নিয়ে কথা বলা। ইংল্যান্ড যাওয়ার তোড়জোড় যখন শেষের দিকে, তখন হঠাৎ তাঁর মাথায় এল, এই কদিন তাঁর ফিনিক্স স্কুলের ছাত্রদের তিনি কোথায় রেখে যাবেন? সকলের পরামর্শ মেনে তিনি তাদের ভারতে পাঠানোর কথাই ভাবলেন। প্রথমে তাঁদের রাখা হয় হরিদ্বারের গুরুকূল আশ্রমে। কিন্তু সেখানকার কঠোর জাতিভেদ ব্যবস্থা গান্ধীজির পছন্দ হল না। তখন তাঁর মনে হল, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনই হতে পারে শিক্ষার্থীদের রাখার আদর্শ জায়গা। রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করায় তিনিও এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। দুপক্ষেরই সম্মতি থাকায় সেরকমই বন্দোবস্ত করা হল। রবীন্দ্রনাথও চিঠি পাঠিয়ে গান্ধীজিকে জানিয়ে দিলেন, “...that you could think of my school as the right and the likely place where your Phoenix boys could take shelter when they are in India, has given me real pleasure... I write this letter to thank you for allowing your boys to become our boys as well and thus form a living link in the Sadhana in both of our lives...”

এর পরের বছর, অর্থাৎ ১৯১৫ সালে ইংল্যান্ডের কাজ মিটিয়ে গান্ধীজি ফিরে এলেন ভারতবর্ষে। ফিরে এসেই তিনি স্থির করলেন, তাঁর ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করার জন্য শান্তিনিকেতনে যাবেন। তাঁর দুই ছেলে তখন স্কিংকস স্কুলের অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে শান্তিনিকেতনেই পড়াশোনা করছেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি গান্ধীজির লেখা টেলিগ্রাম এসে পৌঁছাল শান্তিনিকেতনের অফিসঘরে। টেলিগ্রাম পড়ে জানা গেল, এর ঠিক দু’দিন পরে, অর্থাৎ ১৭ তারিখে মহাত্মা গান্ধী সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে আসছেন।

এই সময় আবার রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ছিলেন না। একটি বিশেষ কাজে কিছুদিনের জন্য তিনি বাস করছিলেন শিলাইদহের বাড়িতে। তবে গান্ধীজি আসার খবরটা ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী মহলে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগল না মোটেই। আশ্রমে যথোচিত মর্যাদায় তাঁদের অভ্যর্থনা জানানোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। আশ্রম প্রাঙ্গণে তোরণ তৈরি হল। রাস্তা পরিষ্কার হল, অভ্যর্থনার আসন-বেদি তৈরি হল। বৈদিক রীতি অনুযায়ী আলপনা আঁকা মাটির আসন আনা হল। নির্দিষ্ট দিনে অধ্যাপক সি.এফ. অ্যান্ড্রুজ ও অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র মজুমদার বর্ধমান স্টেশনে পৌঁছে গেলেন অতিথিদের স্বাগত জানাতে। বর্ধমান থেকে ট্রেন ধরে গান্ধীজিকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা বোলপুর স্টেশনে পৌঁছান।

গোটা তিনদিন ধরে শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখে গান্ধীজি প্রস্তাব করেন, পঠনপাঠনের সঙ্গে সঙ্গে আত্মনির্ভরশীল কর্মী গড়ে তোলা যেতে পারে। এদিকে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শ ছিল বন্ধনহীন আত্মবিকাশের শিক্ষা। ফলে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিল শান্তিনিকেতনের আধিকারিকদের কপালে। যাইহোক, গান্ধীজির ইচ্ছা ছিল শান্তিনিকেতনে আরও কিছু দিন থেকে যাবেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে তবে ফিরবেন। কিন্তু ২০ ফেব্রুয়ারি খবর এল, গতরাতে গোপালকৃষ্ণ গোখলে মারা গিয়েছেন। এই মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পরই গান্ধীজি সস্ত্রীক পুণে রওনা হয়ে গেলেন। হাজার হোক, গান্ধীজি গোখলেকে নিজের গুরুর ন্যায় সম্মান করতেন। ফলে তাঁর শেষকৃত্যে যোগ দেওয়াটা ছিল তাঁর কাছে অবশ্যকর্তব্য।

এরপর দ্বিতীয় দফায় গান্ধীজি শান্তিনিকেতনে আসেন সেই একই বছরের ৬ মার্চ। ছিলেন ১০ মার্চ পর্যন্ত। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ। ফিনিক্স ছাত্রদের স্বাবলম্বন প্রক্রিয়া নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ আলোচনা হয়। গান্ধীজি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, শান্তিনিকেতনে দৈনন্দিন সব কাজ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মিলে যাতে একসঙ্গে করতে পারেন। স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ বুঝতে স্বাবলম্বী হওয়া দরকার। এই কথা রবীন্দ্রনাথেরও পছন্দ হয়। ফলে সেবছর ১০ মার্চ থেকে এই নতুন নিয়ম চালু হয় শান্তিনিকেতনে।

রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এই দিনটির তাৎপর্য নিয়ে লিখছেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন পাইয়া ছাত্ররা (১০ মার্চ ১৯১৫) স্বেচ্ছাব্রতী হইয়া আশ্রমের সকল প্রকার কর্ম করিবার দায় গ্রহণ করিল– রান্না করা, জল তোলা, বাসন মাজা, ঝাড়ু দেওয়া, এমন কি মেথরের কাজ পর্যন্ত। অধ্যাপকদের মধ্যে সন্তোষচন্দ্র মজুমদার, অ্যান্ড্রুজ, পিয়ার্সন, নেপালচন্দ্র রায়, অসিত-কুমার হালদার, অক্ষয়চন্দ্র রায়, প্রমদা রঞ্জন ঘোষ ও জীবনী লেখক প্রভৃতি অনেকেই সেদিন সহযোগিতা করিয়াছিলেন। করেন নাই এমন লোকও ছিলেন। যদিও নানান কারণে এই প্রথা বেশিদিন চলে নাই, তথাপি ১০ মার্চ দিনটি এখনো ‘গান্ধী পুণ্যাহ দিবস’ বলিয়া শান্তিনিকেতনে পালিত হয়। সে দিন প্রাতে পাচক, চাকর, মেথরদের ছুটি দিয়া ছাত্র ও অধ্যাপকেরা সকল প্রকার কাজ আপনাদের মধ্যে ভাগাভাগি করিয়া লইয়া মহোৎসব করেন।’’

শান্তিনিকেতন আম্রকুঞ্জে রবীন্দ্রনাথ ও সস্ত্রীক মহাত্মা গান্ধী

কবিগুরুর আশ্রমে স্বাবলম্বননীতি প্রবর্তনের পরের দিন অর্থাৎ ১১ মার্চ গান্ধীজি রেঙ্গুন চলে গেলেন। তারপর দিন কুড়ি বাদে আবার শান্তিনিকেতনে ফিরে এসে তাঁর ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে শান্তিনিকেতন ত্যাগ করেন। ফিরে গিয়ে তাঁর অনুগামীরা শান্তিনিকেতন সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করার পর তিনি বলেছিলেন– “The visit to Santiniketan was pilgrimage to me.”

এরপর অবশ্য বেশ কয়েকবার বিভিন্ন প্রয়োজনে গান্ধীজি শান্তিনিকেতন সফরে এসেছিলেন। আর শান্তিনিকেতন ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর একাধিকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। তবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের কথা গান্ধীজি যে কোনোদিনই ভুলতে পারেননি, তাঁর লেখা আত্মজীবনীমূলক রচনার ছত্রে ছত্রে তার প্রমাণ মেলে।

গান্ধীজি শেষবারের মতো শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন ১৯৪৫ সালের শেষের দিকে। তখন অবশ্য রবীন্দ্রনাথ আর জীবিত নেই। শান্তিনিকেতনের আশ্রমে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গান্ধীজির শেষ দেখা হয়েছিল ১৯৪০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারিতে। শোনা যায়, ১৯ ফেব্রুয়ারি শান্তিনিকেতন ছাড়ার আগে রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজির হাতে একটি চিঠি তুলে দিয়েছিলেন। সেই চিঠিতে কবি লেখেন যে তাঁর অবর্তমানে বিশ্বভারতীর ভার যেন গান্ধীজি গ্রহণ করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ভারতে শীঘ্রই ব্রিটিশ শক্তির অবসান ঘটবে, এবং তারপর কংগ্রেসই ভারতের শাসনভার গ্রহণ করবে। তাই তিনি গান্ধীজিকেই বিশ্বভারতীর দায়িত্ব দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।

কবির মৃত্যুর (১৯৪১, ৭ আগস্ট) ছ’ বছর পর দেশ স্বাধীন হল। এরপর কালক্রমে ভারতের সংবিধান তৈরি হয়ে পুরোপুরিভাবে আইন প্রণয়নের অধিকার লাভ হল। স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি হলেন ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ। এই সময় গান্ধীজি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া চিঠিটি আবুল কালাম আজাদকে দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি দৃষ্টি রাখবার অনুরোধ করেন। আজাদ সাহেব শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতীকে কেন্দ্র সরকারের তত্ত্বাবধানে আনার ব্যবস্থা করেন। তখন অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজি দু’জনের কেউই আর বেঁচে নেই।

তথ্যসূত্র:

গুরুদেবের কাছে মহাত্মা, মাধব ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯।
রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী ও শান্তিনিকেতন, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, কলকাতা পুরশ্রী, মে ২০১০।
রবীন্দ্রজীবনী, ৪র্থ খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।