সেকালে বলা হত, বড়লোক হওয়ার চূড়ান্ত নিদর্শন হল পুজো করা, অর্থাৎ কিনা দুর্গাপুজো। পুরোনো কলকাতার সব ধনী বাবুদের বাড়িতেই তখন দুর্গাপুজোর চল। কোন বাবু কত টাকা খরচ করলেন, কার পুজোতে কী নতুন চমক দেখা গেল, কার বাড়ির প্রতিমার উচ্চতা অন্য সকলকে ছাপিয়ে গেছে– পুজো শেষ হওয়ার পরেও এইসব গল্প ঘুরত মানুষের মুখে মুখে। বাঙালির অতীতের দুর্গোৎসবের চর্চায় যেসব পরিবারের কথা না বললেই নয়, তার মধ্যে অবশ্যই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো অন্যতম।

ঠাকুরবাড়ির স্বতন্ত্রতার অন্যতম একটি কারণ হল তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্ম। অর্থাৎ তাঁরা ছিলেন নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক। ধর্মীয় ভাবনায় তাঁরা পৌত্তলিকতা বা মূর্তি পুজোয় বিশ্বাসী ছিলেন না। এখন এই ব্রাহ্ম বা নিরাকার ব্রহ্মের উপাসকরা কীভাবে এবং কেনই বা মূর্তিপুজোর মাধ্যমে মাতৃশক্তির আরাধনা করতেন, এটা বুঝতে গেলে ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক ইতিহাসের প্রথম দিককার কিছু কথা বলা প্রয়োজন। 

যতদূর জানা যায় জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের আদি নিবাস ছিল অধুনা বাংলাদেশের যশোহর জেলায় এবং তাঁদের পদবি ছিল ‘কুশারী’। জাতি বা বর্ণ অনুযায়ী সমাজে কুশারীরা হলেন ব্রাহ্মণ। যশোহর থেকে কলকাতায় এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ থেকে সাত পুরুষ আগের পঞ্চানন কুশারী। যশোহর থেকে কলকাতা শহরে এসে তিনি সুতানুটি অঞ্চলে গঙ্গার ঘাটে ব্যবসায়ীদের পুজোআচ্চা করতেন। আর সে কারণেই লোকে তাঁকে ঠাকুরমশাই বলে ডাকতে শুরু করে। ক্রমে তিনি পঞ্চানন কুশারীর থেকেও পঞ্চানন ‘ঠাকুর’ নামেই বেশি পরিচিত হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে তাঁর ও উত্তরসূরীদের পদবী হয়ে যায় ঠাকুর।

পৌরোহিত্য এবং অন্যান্য কাজ করেই একদিন যশোর থেকে আসা পঞ্চানন ও পরবর্তী প্রজন্ম এই শহরে বেশ কিছু সম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠেন। একটা সময় পঞ্চানন ঠাকুরের দুই নাতি নীলমণি ঠাকুর এবং দর্পনারায়ণ ঠাকুরের মধ্যে সেই বিষয়সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ লেগেই থাকত। এই বিবাদ একদিন এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছায়, যার জেরে নীলমণি ঠাকুর ঠাকুর বংশের গৃহদেবতা লক্ষ্মী এবং শালগ্রাম শিলা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন। পরবর্তীকালে তিনি কলকাতার মেছুয়াবাজার অর্থাৎ আজকের জোড়াসাঁকো অঞ্চলে এক সুবিশাল বাড়ি নির্মাণ করেন। নীলমণি ঠাকুর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পত্তন যেমন করেছিলেন, সেই সঙ্গে তিনিই প্রথম ঠাকুর পরিবারে দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন। তবে ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো রাজকীয় আকার ধারণ করেছিল নীলমণি ঠাকুরের নাতি প্রিন্স দ্বারকানাথের হাত ধরেই।

সেকালের কলকাতার যে কোনও জমিদার বা বনেদি পরিবারের দুর্গাপুজোকে টেক্কা দিতে পারত ঠাকুর পরিবারের পুজো। বিশাল বাড়ির প্রকাণ্ড খোলা ঠাকুরদালানে হত মাতৃ আরাধনার আয়োজন। উল্টোরথের দিন প্রতিমা গড়ার মাটি আসত গঙ্গার পাড় থেকে। কাঠামো পুজো সারা হলে সেই কাঠামোয় মাটির প্রলেপ পড়ত। মূর্তিশিল্পী সমস্ত নিয়ম মেনে প্রলেপের পর প্রলেপ চড়িয়ে দেবী দুর্গার অবয়ব ফুটিয়ে তুলতেন। প্রকাণ্ড ঠাকুরদালানে প্রতিমা নির্মাণের কাজ হত পর্দার আড়ালে। 

ঠাকুরবাড়ির দেবী দুর্গার বৈশিষ্ট্য ছিল অর্ধচন্দ্রাকৃতির একচালার মূর্তি। তবে বিশেষ গুরুত্ব পেত প্রতিমার মুখের আদল। প্রিন্স দ্বারকানাথের স্ত্রী দিগম্বরী দেবী ছিলেন অসামান্যা সুন্দরী এক নারী। কথিত আছে তাঁর আমলে ঠাকুরবাড়ির দুর্গামূর্তি দিগম্বরী দেবীর মুখের আদলে তৈরি করা হত। কেবলমাত্র দেবীর মুখাবয়ব নয়, পুজোর দিনগুলিতে মূর্তিকে দু’বেলা বেনারসী শাড়ি বদল করে পরানো হত, আবার কখনও পরানো হত দামি তসর কিংবা গরদের শাড়ি। প্রতিমায় পরানো হত প্রচুর সোনার গয়না। মাথায় সোনার মুকুট থেকে কোমরে চন্দ্রহার সবই প্রতিমার গায়ে শোভা পেত। পুজোর কটাদিন হাজার ব্যস্ততা সত্ত্বেও সন্ধ্যারতির সময় ঠাকুরদালানের সামনে পুত্রদের নিয়ে উপস্থিত থাকতেন স্বয়ং দ্বারকানাথ।

ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজোতে সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরাও আমন্ত্রণ পেতেন। আমন্ত্রণপত্রে লেখা থাকত দ্বারকানাথের পিতা রামমণি ঠাকুরের নাম। একবার দেবেন্দ্রনাথ পিতামহের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে হাজির হয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের কাছে। দেবেন্দ্রনাথের বয়স তখন সবে বারো ছুঁয়েছে। প্রতিমা পুজোয় বিরোধী রামমোহন আমন্ত্রণপত্র পেয়ে তখন খুবই বিস্মিত হন। বন্ধু দ্বারকানাথের সঙ্গে তাঁর খুবই হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল বলে তিনি নিমন্ত্রণপত্রটি প্রত্যাখ্যান করেননি, আবার সরাসরি সেটি গ্রহণও করেননি। তিনি তাঁর ছেলে রাধাপ্রসাদের কাছে দেবেন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দিলেন। রাধাপ্রসাদ পিতার হয়ে ঠাকুরবাড়িতে গেছিলেন পুজো দেখতে।

রাজকীয় বৈভবে পুজো শেষ হত নবমীর রাতে। পরের দিন দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন। বিসর্জনের শোভাযাত্রা দেখতে ভিড় জমাত প্রচুর লোক। বাড়ির কাছেই যেহেতু গঙ্গা, তাই মাতৃপ্রতিমার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির মেয়ে-বউরাও গঙ্গার ঘাট অবধি যেত। তারা যেত দরজা বন্ধ করা পাল্কিতে করে। এই পুরো শোভাযাত্রায় যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা না হয় সে কারণে শোভাযাত্রার সাথে যেত প্রহরীরা। যাদের হাতে থাকত পিতলে বাঁধানো লাঠি। একবার নিজের শখে প্রতিবেশীদের কাছে বড়াই করে প্রতিমার জন্য প্যারিস থেকে বহুমূল্য ফরমায়েশি গয়না আনিয়েছিলেন দ্বারকানাথ। শোনা যায় সে বছর তাঁরই নির্দেশে সেই সব বহুমূল্য গয়না সমেতই দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল।

এই দশমীই ছিল বছরের মধ্যে মাত্র এক দিন, যে দিন খোলা ছাদে ওঠার অনুমতি মিলত বাড়ির মেয়েদের। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে সৌদামিনী দেবী একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন, “বিজয়ার দিন প্রতিমার নিরঞ্জনের মিছিলে ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা যোগ দিতেন। তারা বিজয়ার দিনে নতুন পোশাক পরিয়া প্রতিমার সঙ্গে চলিত, আর আমরা মেয়েরা সেইদিন তেতালার ছাদে উঠিয়া প্রতিমা বিসর্জন দেখিতাম। তখন বৎসরের মধ্যে সেই একদিন আমরা তেতলার ছাদে উঠিবার স্বাধীনতা পাইতাম।” 

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ছবি ‘বিসর্জন’

প্রতিমা ভাসানের পর ঠাকুরবাড়িতে প্রতিবছরই ঘটা করে অনুষ্ঠিত হত ‘বিজয়া সম্মিলনী’। বিজয়া সম্মিলনীতে ঠাকুরবাড়িতে বসত মস্ত জলসা। সেকালের নামকরা ওস্তাদরা তাঁদের গানে মাতিয়ে রাখতেন আমন্ত্রিত অতিথিদের। ঝাড়বাতির নীচে চলত বিজয়ার খাওয়াদাওয়া, মিষ্টিমুখ, গোলাপজল, আতর, পান আর কোলাকুলি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি লেখায় লিখেছেন, “বিজয়া ছিল আমাদের খুব আনন্দের দিন। সেদিনও কিছু কিছু পার্বণী মিলত। আমাদের বুড়ো বুড়ো কর্মচারী যাঁরা ছিলেন, যোগেশদাদা প্রভৃতিকে আমরা পেন্নাম করে কোলাকুলি করতুম। বুড়ো বুড়ো চাকরাও সব এসে আমাদের টিপটিপ করে পেন্নাম করত। তখন কিন্তু ভারি লজ্জা হত। খুশিও যে হতুম না তা নয়। কর্তামশায়কে, কর্তাদিদিমাকে এবাড়ির-ওবাড়ির সকলেই প্রণাম করতে যেতুম। বরাবরই আমরা বড়ো হয়েও কর্তামশায়কে প্রতিবছর প্রণাম করতে যেতুম। তিনি জড়িয়ে ধরে বলতেন, ‘আজ বুঝি বিজয়া!’”

--

ঠাকুরবাড়ির এই পুজো অবশ্য বেশিদিন চলেনি। রামমোহন রায়ের সান্নিধ্যে এসে দ্বারকানাথ একেশ্বরবাদী ঐশ্বরিক ধর্মকে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেন। যদিও সেই সময় বাড়ির দুর্গাপুজোয় তিনি অংশগ্রহণ করতেন বলেই জানা যায়। রামমোহন, দ্বারকানাথ দুজনেরই দেহত্যাগের পর খানিকটা আকস্মিকভাবেই দেবেন্দ্রনাথ ব্রহ্ম উপাসনায় মনোনিবেশ করেন এবং ব্রাহ্মসমাজের হাল ধরেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ যখন ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলেন, তার পরও কিছুকাল প্রতিমা গড়ে দুর্গাপুজো করেছিলেন তিনি। তারপর অবশ্য একটা সময়ে তিনি ‘পুতুলপুজো’ বন্ধ করে দেন। তার পরিবর্তে দুর্গা-দালান ও উল্টো দিকের নাট্যমঞ্চকে ব্যবহার করা শুরু করেন মাঘোৎসব উপলক্ষে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য।

তথ্যসূত্র:

পুজো করতেন দ্বারকানাথ-দেবেন্দ্রনাথ! ব্রাহ্ম হয়েও কী ভাবে ঠাকুরবাড়িতে শুরু হল দুর্গাপুজোর চল?, এলিনা দত্ত, এই সময়, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২।
নীলমণি ঠাকুরের আমলে দুর্গাপুজো শুরু হলেও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ধুমধাম শুরু দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলেই
গয়না পরেই ভাসান দেবীর, দুর্গাপুজো হত জোড়াসাঁকোর ব্রাহ্ম ঠাকুরবাড়িতেও