বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ১৮৭৭ সালে। রায় পরিবারের ছেলেরা অবশ্য তার আগে থেকেই গ্রামের মাঠে ক্রিকেট খেলতেন। বঙ্গদেশে ক্রিকেট খেলা বিষয়ে আলোচনা করতে হলে প্রথমেই যে পরিবারের কথা বলতেই হয়, তা হল পূর্ব বাংলার মসুয়া গ্রামের রায় বংশ। এই পরিবারের পাঁচ ভাই ছিলেন ক্রিকেটের ভক্ত– সারদারঞ্জন, উপেন্দ্রকিশোর, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন ও প্রমদারঞ্জন। ৮ বছর বয়সে সারদারঞ্জন যখন পড়তেন কিশোরগঞ্জ মাইনর স্কুলে, তখন স্কুলে যাওয়ার সময় তাঁর এক হাতে থাকত বই, আরেক হাতে ব্যাট।

১৮৮০ সালে সারদারঞ্জন ও তাঁর চার ভাই মিলে গড়ে তোলেন ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাব। ভারতে তখন ক্রিকেট খেলতেন ব্রিটিশ সাহেব এবং অভিজাত ভারতীয়রা। রায়চৌধুরী ভাইরা সেই খেলাকে বাংলার আমজনতার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগী হন।

তখন ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম কেনার খরচ ছিল সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। সারদারঞ্জনের উদ্যোগে ১৮৯৫ সালে কলকাতায় যাত্রা শুরু করে ‘এস রায় অ্যান্ড কোম্পানি’। বাংলার প্রথম ক্রিকেট সামগ্রীর দোকান। তারপর গড়ে ওঠে ক্রিকেটসামগ্রীর কারখানা। ক্রিকেট কোচ হিসেবেও কৃতিত্বের ছাপ রেখেছেন সারদারঞ্জন। তাঁকে বলা হয় ‘বাংলার ক্রিকেটের জনক’। তাঁর ভাই উপেন্দ্রকিশোর বাংলায় প্রথম কিংবদন্তি ক্রিকেটার রঞ্জির জীবনী লিখেছিলেন। মুক্তিদারঞ্জন এবং কুলদারঞ্জন ছিলেন দুর্ধর্ষ ব্যাটসম্যান। প্রমদারঞ্জনও ফাস্ট বোলার হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন।

সারদারঞ্জন, উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার ও সত্যজিৎ

নারীদের ক্রিকেট খেলার সূচনাও হয়েছিল রায় পরিবারের হাত ধরে। তখন গ্রামের মেয়েদের পক্ষে ব্যাটবল জোগাড় করা অসম্ভব ছিল। তাই রায় পরিবারের মেয়েরা কাঠের তক্তা এবং শুকনো কুমড়ো দিয়েই কাজ চালাতেন। শোনা যায়, মসুয়া গ্রামের রায়বাড়ির উঠোনে মেয়েদের ক্রিকেট খেলা দেখতে ভিড় করতেন আশেপাশের গ্রামের লোকজনেরা।

রায় পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম, অর্থাৎ উপেন্দ্রকিশোরের পুত্র সুকুমারের যে ক্রিকেটের প্রতি অমোঘ আকর্ষণ ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর চিঠিপত্রে। সুকুমার যখন ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়েছিলেন, বাবা উপেন্দ্রকিশোর এবং কাকা কুলদারঞ্জনকে চিঠি লিখে নিয়মিত ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা করতেন। শোনা যায়, কলকাতার মার্কাস স্কোয়ারে স্পোর্টিং ইউনিয়নের খেলাও দেখতে যেতেন সুকুমার। 

সুকুমারের ক্রিকেট-প্রীতির আভাস পাওয়া যায় তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির মধ্যেও। ‘বোম্বাগড়ের রাজা’ ছড়ায় সুকুমার লিখেছিলেন, “সভায় কেন চেঁচায় রাজা ‘হুক্কা হুয়া’ ব’লে? / মন্ত্রী কেন কলসী বাজায় ব’সে রাজার কোলে? / সিংহাসনে ঝোলায় কেন ভাঙা বোতল শিশি? / কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসি?” আবার ‘জগ্যিদাসের মামা’ গল্পেও সুকুমার ক্রিকেটের প্রসঙ্গ এনেছেন– “জগ্যিদাসের মামার কথা আমাদের ভারি আশ্চর্য ঠেকত। তার গায়ে নাকি যেমন জোর তেমনি অসাধারণ বুদ্ধি। তিনি যখন ‘রামভজন’ বলে চাকরকে ডাক দিতেন, তখন ঘর বাড়ি সব থরথর করে কেঁপে উঠত। কুস্তি বল, লাঠি বল, ক্রিকেট বল, সবটাতেই তাঁর সমান দখল।”

কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসি?

সুকুমারের সুযোগ্য পুত্র সত্যজিৎ রায়ের ক্রিকেট-প্রীতিও আমাদের কারোর অজানা নয়। সামাজিক মাধ্যমে সত্যজিতের গাঢ় রঙের পাজামা এবং ফুল হাতা শার্ট পরা একটি ছবি আমরা মাঝেমধ্যেই ঘুরতে দেখি। জানা যায় টালিগঞ্জের কলাকুশলীদের মধ্যে একটি সৌজন্যমূলক ক্রিকেট ম্যাচে তিনি খেলেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও। সেই ম্যাচে সত্যজিতের সহ-অধিনায়ক ছিলেন উত্তম কুমার।

সত্যজিৎ নিজে স্লো স্পিন বল করতে পছন্দ করতেন বলে গল্পের গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্রকেও একইভাবে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। সত্যজিতের প্রথম পূর্ণাঙ্গ গোয়েন্দা গল্প ‘বাদশাহী আংটি’-র একেবারে শুরুতে লখ্‌নৌর বর্ণনা প্রসঙ্গে ফেলুদার মুখে এই কথাটা শুনতে পাই আমরা– ‘ফিফটি এইটে গেসলাম ক্রিকেট খেলতে। জায়গাটা নেহাত ফেলনা নয়।’ পরে গল্পের আরেক চরিত্র মহাবীরের সঙ্গে একটা বুক স্টলে দেখা হয় ফেলুদার। সেই সময় ফেলুদা মহাবীরকে নিজের পুরোনো জীবনের কথা বলেন। মহাবীরও জানিয়ে দেন তিনি ডুন স্কুলের প্রথম একাদশে খেলেছিলেন।

ফেলুদা ছাড়াও সত্যজিতের আরেক কীর্তি তারিণীখুড়োকেও একটি গল্পে ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। ‘খেলোয়াড় তারিণীখুড়ো’ নামক সেই গল্প মার্তণ্ডপুর ক্রিকেট ক্লাব (এম.সি.সি.) ও প্ল্যান্টার্স ক্লাবের মধ্যে একটি বার্ষিক ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। খুড়ো তখন মধ্যপ্রদেশের মার্তণ্ডপুর রাজ্যের রাজা বীরেন্দ্রপ্রতাপ সিংয়ের কর্মচারী। বার বার হারতে থাকা এম.সি.সি. দলের মান বাঁচানোর দায়িত্ব পড়ে তারিণীর ওপরই। গল্পের ক্লাইম্যাক্সের শেষে জানা যায় ২৪৩ রান করে দলকে জিতিয়ে দিয়েছেন তারিণীখুড়ো।

বল হাতে সত্যজিৎ রায়

ব্যাট হাতে তারিণীখুড়ো

ক্রিকেটের বিষয়ে ভালোলাগার কথা শুধুমাত্র গল্প, উপন্যাসেই নয়, রায়বাবুর অনেকগুলো সিনেমাতেও ক্রিকেটের প্রসঙ্গ এসেছে। যেমন কাঞ্চনজঙ্ঘা (১৯৮৫), অরণ্যের দিন রাত্রী (১৯৭০)। কাঞ্চনজঙ্ঘা চলচ্চিত্রে অভিনয় করা ছবি বিশ্বাসকে বলতে শোনা যায় যে, ছাত্র জীবনে তিনি একবার ৯৬ রান করে ব্রিটিশ স্পিনার ‘গ্রিগস’-এর বলে বোল্ড হয়ে যান।

সত্যজিৎ রায়ের ক্রিকেট প্রতিভার আরও একটি প্রমাণ পাওয়া যায় লেগ স্পিনার হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলা একটি ম্যাচে। একশো বছর আগে পরিবারের দুই সন্তান সারদারঞ্জন ও উপেন্দ্রকিশোর ক্রিকেটের প্রতি যে ভালোবাসা দেখিয়েছিলেন, তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের রক্তেও যে তা সমান ভাবে সঞ্চারিত হবে তাতে আর সন্দেহ কী!

তথ্যসূত্র: