বাঙালির নববর্ষে মিষ্টিমুখের প্রসঙ্গ উঠলেই যে নামগুলো সবার প্রথম মাথায় আসে তার মধ্যে অবশ্যই সন্দেশ, জিলিপি, কালাকাঁদ, রসগোল্লা, জলভরা এগুলোর নাম উল্লেখ করতেই হয়। নববর্ষের দিন জমিয়ে খাওয়াদাওয়া তো আছেই, কিন্তু সকাল সকাল উঠে লুচি আর সাদা আলুর তরকারির সঙ্গে শেষ পাতে একটা নরম পাকের সন্দেশ না হলে নতুন বছরের সেলিব্রেশনটা যেন ঠিক শুরু হয় না। তারপর দুপুরে কব্জি ডুবিয়ে মাংস-ভাত খেয়ে বিকেল বিকেল বন্ধুদের সঙ্গে ইয়ার্কিই হোক, অথবা কুটুমের বাড়িতে গিয়ে আড্ডা– নাটকের ক্লাইম্যাক্সে কিন্তু মিষ্টির পজিশন পাকা। মাথায় ছোটো, বহরে বড়ো বাঙালি সন্তান বছরের এই একটা দিন ব্লাড সুগারের অঙ্ক ভুলে যে হারে মিষ্টান্ন-প্রীতি প্রদর্শন করেন, তা বিশ্বের আর কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যায় কিনা বলা মুশকিল।

ভেবে দেখতে গেলে ভোজনরসিক বাঙালির খাদ্যতালিকায় খাবারের কোনো অভাব নেই। চিরাচরিত ভাত-ডাল-মাছ তো রয়েইছে; সঙ্গে আবার অধুনাকালের বিভিন্ন বিদেশি রান্নাবান্নাও বাঙালির হেঁশেল অনেকটাই দখল করে ফেলেছে। কিন্তু এই পিৎজা-পাস্তা-বিরিয়ানি-ফিশফ্রাইয়ের যুগেও বাঙালি চায় মিষ্টি। রোজ সকালে বাজার করে ফেরার পথে ও পাড়ার মিত্তিরমশাই এখনও মিষ্টির দোকানগুলোতে একবার করে ঢুঁ মেরে যান কোনো নতুন ধরনের মিষ্টি এসেছে কিনা দেখার জন্য। এর থেকে মনে প্রশ্ন জাগে, বাঙালির রক্তে কী এমন রয়েছে যার জন্য বিয়ে থেকে পুজোপার্বণ যে কোনও উৎসবে বাঙালির মন ছুটে যায় মিষ্টির দিকেই? এর উত্তর নেই খোদ মিষ্টি বিক্রেতাদের কাছেও। যুগের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে মিষ্টির ধরন, বদলেছে বাঙালির খাওয়ার ধরনও। কড়াপাক, নরম পাকের সন্দেশের পাশাপাশি বাজারে এসেছে হরেকরকম ফিউশন সন্দেশও। কিন্তু বছরের পর বছর কেটে গেলেও বাঙালির কাছে মিষ্টির চাহিদা কমেনি এতটুকুও। অন্তত শহর কলকাতার নামকরা কিছু মিষ্টির দোকানে পয়লা বৈশাখের মিষ্টি বিক্রির পরিসংখ্যান তো তাই বলছে।

মিষ্টি, অথবা বলা ভালো মিষ্ট স্বাদের প্রতি বাঙালির এই ভালোবাসার শিকড় অবশ্য লুকিয়ে আছে আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনধারাতেই। আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষদের কাছে দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম ছাড়াও অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ ছিল পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবারের জোগান এবং শক্তি সঞ্চয়। প্রকৃতিতে, মিষ্টি স্বাদ শর্করার উপস্থিতি বোঝায়, এবং এটি ক্যালোরির একটি চমৎকার উৎস। তাই আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষরা এমন খাবার সংগ্রহ করত (বিশেষত গাছপালা) যার স্বাদ মিষ্টি এবং এর ফলে তারা শরীরে অনেক বেশি ক্যালোরি মজুত করতে পারত।

মিষ্ট স্বাদ শনাক্তকরণের ক্ষমতা লুকিয়ে থাকে আমাদের জিনেও। আমরা জানি আমাদের জিভের মধ্যে থাকা স্বাদকোরকগুলি বিভিন্ন রকম স্বাদের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল– টক, নোনতা, তিক্ত, মিষ্টি প্রভৃতি। এদের মধ্যে মিষ্টি শনাক্তকারী স্বাদকোরকগুলি TAS1R2/3 নামে একটি রিসেপ্টর প্রোটিন গঠন করে, যা শর্করা জাতীয় খাবার শনাক্ত করতে সাহায্য করে। এই গোটা প্রক্রিয়াটি যখন সংগঠিত হয়, তখন আমাদের মস্তিষ্কে অনবরত একপ্রকার স্নায়বিক সংকেত আসা যাওয়া করতে থাকে। আর এইভাবে আমরা খাবারের মিষ্টতা উপলব্ধি করতে পারি।  

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় ১৫৪০ সাল নাগাদ পর্তুগিজরা যখন হুগলির ব্যান্ডেলে কুঠি নির্মাণ করে ব্যবসার কাজ শুরু করেন, তখনও বঙ্গদেশে সন্দেশের প্রচলন হয়নি। পর্তুগিজরা সেই সময় দুধ কাটানো ছানা থেকে এক ধরনের সুস্বাদু চিজ তৈরি করতেন। ক্রমে যা ‘ব্যান্ডেল চিজ’ নামে জনপ্রিয় হয়। পরে চুঁচুড়াতে ঘাঁটি গেড়ে ওলন্দাজরাও নাকি এই ব্যান্ডেল চিজের ভক্ত হয়ে পড়েছিল। বলা বাহুল্য এইসব বিদেশি বণিকদের রন্ধনশালায় কাজ করতেন অনেক স্থানীয় বাঙালি নাগরিক। ক্রমে তাদের হাত ধরে বাংলায় জনপ্রিয় হয় ঘন দুধ জ্বাল দিয়ে তৈরি করা এই রেসিপি, যাকে এখন আমরা ‘ছানা’ বলে চিনি। এই ছানাই পরে বাঙালি মোদকদের হাতে পড়ে ছানার মিষ্টিতে পরিণত হয়। ছানার তৈরি মিষ্টি, বিশেষ করে সন্দেশ, পরবর্তীকালে বাংলা হয়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমদিকে সন্দেশ তৈরি হত ছানা আর গুড় দিয়ে।সন্দেশে চিনির ব্যবহার শুরু হয় অনেক পরে। তবে যে কোনও সুস্বাদু খাবারের মত সন্দেশের জন্যেও প্রয়োজন ছিল উৎকৃষ্ট উপকরণ আর দক্ষ ও অভিজ্ঞ কারিগরের।

তবে সত্যি বলতে বাঙালি সংস্কৃতিতে সন্দেশের আবির্ভাব কবে, কোন সময়ে তা অনেকেই এখনও সঠিক বলতে পারেন না। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে, যেমন কৃত্তিবাসী রামায়ণ, ধর্মমঙ্গল, চৈতন্যচরিতামৃত প্রভৃতিতে মিষ্টান্ন হিসেবে মণ্ডার উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার আলালের ঘরে দুলাল, স্বপ্নপ্রয়াণ, দাশরথির পাঁচালিতেও মণ্ডা অতিমাত্রায় বিরাজমান। পণ্ডিতেরা মনে করেন এই মণ্ডাই হচ্ছে আদি মিষ্টান্ন, সন্দেশের পূর্বপুরুষ। 

তবে এই মণ্ডা থেকে সন্দেশের উৎপত্তি কীভাবে হল সে বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। কারণ নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙালির ইতিহাস’ বইতে মিষ্টিজাতীয় যেসব খাবারের কথা উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে কোনো ছানার মিষ্টি নেই। দুধ থেকে তৈরি মিষ্টির মধ্যে আছে দই, ক্ষীর আর পায়েসের কথা। কয়েক জায়গায় সন্দেশের উল্লেখ আছে কিন্তু সেই সন্দেশ আবার ছানার নয়। ফলে মনে দ্বিধা থেকেই যায়। 

আগেকার দিনে কুটুম্ব বাড়িতে খোঁজখবর নেবার বা ভালো খবর দেবার জন্য লোক পাঠালে তারা খালি হাতে যেত না; সাথে নিয়ে যেত হাঁড়িভরা মিষ্টি। সাধারণ লোকজন তখনকার দিনে পাঠাতো বাতাসা। কিন্তু কলকাতার বাবুরা বড়লোক বলে মণ্ডার বদলে তাঁরা পাঠাতেন ছানার মণ্ডা! এই ‘খবর নেওয়ার’ বা তত্ত্ব করার কলকাতায় এই মিষ্টির পন্ডিতি নাম হয় ‘সন্দেশ’!

সে যাই হোক, পর্তুগিজ শাসন থেকে বেরিয়ে ব্রিটিশ শাসনে প্রবেশ করলেও দেখা যাবে নিত্যনতুন মিষ্টির সম্ভার। যেমন ধরা যাক লেডিকেনির কথা। বঙ্গেশ্বর লর্ড ক্যানিংয়ের স্ত্রীর সম্মানে তৈরি মিষ্টি-কাহিনি তো কিংবদন্তি। অথবা, পশ্চিম মেদিনীপুরের ক্ষীরপাইয়ের বাবরশা। শোনা যায়, এডোয়ার্ড বাবর নামে এক ইংরেজ রেসিডেন্টের সম্মানে এই মিষ্টান্নটি তৈরি করেছিলেন পরাণ আটা নামে এক মোদক। অনেকে বলে থাকেন, বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ের মেচা সৃষ্টির সঙ্গে নাকি মল্লরাজাদের যোগ রয়েছে। বর্ধমানের মিহিদানা ও সীতাভোগও নাকি তৈরি হয়েছিল বর্ধমানের মহারাজার অনুরোধ বা আদেশে। তিনি নাকি বাংলার গভর্নর এবং কলকাতা হাইকোর্টের দুই বিচারপতির আপ্যায়নে এই মিষ্টান্ন তৈরি করিয়েছিলেন। আবার মুর্শিদাবাদের ছানাবড়ার সৃষ্টিতত্ত্বে মতান্তর রয়েছে। এদের মধ্যে বহুল প্রচারিত একটি মত বলে, বহরমপুরের রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী কোনও এক ইংরেজকে তুষ্ট করতে পটল ওস্তাদ নামে এক মোদককে ছানাবড়া তৈরির বরাত দেন। 

দেশীয় রাজরাজরা বা ব্রিটিশ সাহেবদের পাশাপাশি মিষ্টিমোহে মজেছিলেন শিবরাম কিংবা বিভূতিভূষণের মতো লেখকরাও। একবার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পুরী গিয়েছেন, সঙ্গী গজেন্দ্রকুমার মিত্র এবং সুমথনাথ ঘোষ। বিভূতিভূষণ মালপোয়া খেতে চাইলেন। তখন রাত। মালপোয়া পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এমন সময় পান্ডার ছড়িদার পৌঁছে দিলেন মালপোয়া। জানালেন, জগন্নাথ দেবের শৃঙ্গারভোগ নেমেছে। পান্ডা পাঠিয়েছেন। আপনারা অনেকেই কবি কৃষ্ণধন দে’র নাম শুনেছেন। বাংলার প্রথম কথা-বলা সিনেমার অনেক গান লিখেছিলেন ইনি। বর্ধমানে একবার কোনও সাহিত্যসভায় যাওয়ার সময়ে তাঁর দুর্ঘটনা ঘটে। বর্ধমান হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। নার্স কৃষ্ণধনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “খাবেন কিছু? কী দেব?” কৃষ্ণধন নার্সকে জানিয়েছিলেন, এক সের মিহিদানা খাবেন। বর্ধমান হাসপাতাল শুনে তাঁর মিহিদানার কথাই মনে হয়েছিল। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নামে আশুভোগ সন্দেশ, মোতিলাল নেহরুর নামে নেহরু সন্দেশ তো আছেই; এমনকি শিবরাম চক্রবর্তীর রাবড়ি-প্রীতি দেখে রাবড়ি-চূর্ণ নামেও একপ্রকার মিষ্টি তৈরি করা হয়েছিল। 

লেখকদের কথা উঠলেই বইপাড়ায় নববর্ষ পালনের প্রসঙ্গ এসে পড়াটা স্বাভাবিক। নববর্ষে প্রকাশকের দফতরে মিষ্টিমুখও তাই পুরোনো ঐতিহ্য। পয়লা বৈশাখে লেখকদের নিয়ে আড্ডা, সাহিত্যপাঠের এই রীতির প্রবর্তক ‘গুপ্তকবি’ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। এইসব সভায় প্রবন্ধ, কবিতা যেমন পাঠ হত, তেমনই সভা শেষে থাকত মহাভোজ। পয়লা বৈশাখে কলেজ স্ট্রিটে খাওয়াদাওয়া আর সাহিত্যিক সমাবেশের এই রীতি রয়ে গেছে আজও। আর সেই সঙ্গে বাঙালির আত্মীয়তা আরো গভীর হয়েছে হরেকরকম মিষ্টান্নের প্রতি।

তথ্যসূত্র:

মিষ্টি-মুগ্ধতায় আবিষ্ট দেবতা থেকে শাসক, দীপক দাস, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ এপ্রিল ২০২৩।
সন্দেশের ইতিবৃত্ত, দেবাশিষ মজুমদার, আজকাল, ১৩ এপ্রিল ২০২৩।
আদি জনতা মিষ্টান্ন ভান্ডার: এপার বাংলার মধুময় অতীত বর্তমান, উৎপল ঝা ও স্বাগতা দাস মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত, প্রতিক্ষণ।
কলেজস্ট্রিটের সত্তর বছর (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), সবিতেন্দ্রনাথ রায়, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।
বাংলার খাবার, প্রণব রায়, সাহিত্যলোক।