তারিখটা ১৮৮৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর। ঐদিন ছিল তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার ত্রয়োদশতম জন্মদিন। ভাইঝির জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ সেদিন ‘জন্মতিথির উপহার’ নামে একটি কবিতা লেখেন। কাগজে লেখা সেই কবিতার সঙ্গে একটি সুদৃশ্য কাঠের বাক্স উপহার দেন তেরো বর্ষীয় ‘বিবি’কে। এই ‘বিবি’ হলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী এবং সত্যেন্দ্রনাথের একমাত্র কন্যা, ইন্দিরা দেবী।
এর আগে ঠাকুর পরিবারে ধুমধাম করে জন্মদিন পালনের কোনো খবর জানা যায় না। কিন্তু বিবির এই জন্মদিন পালনের ঘটনা হয়ত কবির মনকে উতলা করে তুলেছিল। বিবির জন্মদিনের ছ’মাস পর কবির অন্তরের সেই সুপ্ত বাসনা ধরা দেয় বন্ধুবর শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লেখা একটি চিঠিতে। ১৮৮৬ সালের ৭ মে অর্থাৎ পঁচিশে বৈশাখ সেই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন: ‘আজ আমার জন্মদিন – পঁচিশে বৈশাখ – পঁচিশ বৎসর পূর্ব্বে এই পঁচিশে বৈশাখে আমি ধরণীকে বাধিত করতে অবতীর্ণ হয়েছিলুম। জীবনে এমন আরও অনেকগুলো পঁচিশে বৈশাখ যেন আসে এই আশীর্ব্বাদ করুন।..’
ততদিনে ছাব্বিশ বছরের যুবক রবি নিজগুণে পরিবারের সদস্যদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় হয়ে উঠেছেন। ফলস্বরূপ পরের বছর তাঁর ভাগ্নি, ‘সল্লি’ অর্থাৎ সরলা দেবী একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেন। সেই বছর রবীন্দ্রনাথ ২৭ বছরে পা দিয়েছেন। ১৮৮৭ সালের ৭ মে’র সেই দিনটি ছিল শনিবার। সরলা দেবী খুব ভোরে কাশিয়াবাগান থেকে দাদা জ্যোৎস্নানাথকে সঙ্গে নিয়ে চলে যান পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে। সঙ্গে নেন বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা। পথে কিনে নেন বেল ফুলের মালাসহ অন্যান্য আরো ফুল। এছাড়া একজোড়া ধুতি-চাদর এবং একটি ইংরেজি কবিতার বই, The Poems of Heine নিয়ে সোজা চলে যান ৪৯ নং পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে। ঘুমন্ত রবীন্দ্রনাথকে জাগিয়ে ফুল মালা ধুতি চাদর – এইসব তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করেন। জ্যোৎস্নানাথও রবিমামাকে প্রণাম করে কবিতার বইটি উপহার দেন, যা পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে পাওয়া প্রথম উপহার হিসেবে স্বীকৃত হয়।
এরপর কবির জীবনে অনেক জন্মদিন এসেছে। পরবর্তী বেশ কয়েক বছর পরিবারের মধ্যেই তাঁর জন্মদিন পালনের ধারা অব্যাহত ছিল। ১৮৯৫ সালে কবির ৩৫-তম জন্মদিনে কিটস, শেলি, ব্রাউনিং, টেনিসনসহ বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রমুখ সর্বজন পরিচিত কবিদের ৭২ টি কবিতা ইন্দিরা দেবী নিজের হাতে নকল করে ২৮০ পাতার একটি সুদৃশ্য বাঁধানো খাতা উপহার দিয়েছিলেন তাঁদের প্রিয়তম রবিকাকে। এছাড়াও পরবর্তী দুটি জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ দুটি কবিতা উপহার পান প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এবং প্রিয়নাথ সেনের কাছ থেকে। এরপর ৪২ বছরের জন্মদিন পালন করা হয় শান্তিনিকেতনে। লক্ষ্য করার বিষয় ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল থেকে তিনি তখন বিশ্বমহলে সমাদৃত হচ্ছেন।
জন্মদিন নিয়ে তাঁর বিশেষ কোনও অনুভূতি থাকলেও, তা সর্বসমক্ষে কোনোদিনই প্রকাশ করেননি রবীন্দ্রনাথ। ১৯০৯ সালে বোলপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবর্ধনা-ভাষণে জন্মদিনের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “কত পঁচিশে বৈশাখ চলে গিয়েছে, তারা অন্য তারিখের চেয়ে কিছুমাত্র বড়ো করে আমার কাছে প্রকাশ করেনি।” ‘জন্মোৎসব’ প্রবন্ধেও প্রায় একই কথা তিনি উদ্ধৃত করেছেন, “উৎসব হচ্ছে জীবনের কবিত্ব, যেখানে রস সেইখানেই তার প্রকাশ।... আজ আমার জন্মদিনে তোমরা যে উৎসব করছ, তার মধ্যে যদি সেই কথাটি থাকে, তোমরা যদি আমাকে আপন করে পেয়ে থাক, আজ প্রভাতে সেই পাওয়ার আনন্দকেই যদি তোমাদের প্রকাশ করবার ইচ্ছা হয়ে থাকে, তা হলেই এই উৎসব সার্থক।”
সেবার আম্রকুঞ্জে অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় ভোরবেলা। সাজানো হয়েছিল ফুল, আলপনায়। একেবারে ভারতীয় ধাঁচে জন্মদিন উদযাপন। সেখানে গানে গানে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনই ছিল মূল কথা। প্রথমে মঙ্গলগীত, তারপর একে একে বিদ্বজ্জনের ভাষণ। অনুষ্ঠান শেষে কবিকে অসংখ্য ফুলের মালা পরিয়েছিলেন ছাত্ররা। সেইসঙ্গে প্রণাম করার ধুম ছিল দেখার মত। সুনীল দাস তাঁর বইয়ে লিখছেন, প্রায় আধঘণ্টারও বেশি সময় দাঁড়িয়ে থেকে রবীন্দ্রনাথ প্রায় শ-তিনেক মানুষের প্রণাম গ্রহণ করলেন। তবে এই সবকিছুর মধ্যে কবিগুরুর প্রতিভাষণটি বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। সমীর দাসের বইয়েই সে অংশের সন্ধান মেলে। কবি বলছেন, “আমাকে আপনারা যে উপহার দিলেন, সেগুলি পাবার আমি কতখানি যোগ্য তা যদি আমি মনে করতে যাই, তাহলে আমাকে লজ্জিত হতে হবে। কিন্তু একটা ক্ষেত্র আছে, যেখানে মানুষের কোনও লজ্জা নেই, সেটা প্রীতির ক্ষেত্র। এইসব উপহার আপনারা আমাকে প্রীতির সহিত দিচ্ছেন, সেইজন্য এসব গ্রহণ করতে আমার কোনও বাধা নেই।”
পঞ্চাশতম জন্মদিনে আশ্রমবাসিরা রবীন্দ্রনাথকে আগে থেকে না জানিয়ে মহাসমারোহে জন্মদিন পালন করলেন। কবি এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন যে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রফুল্লকুমার সরকারের স্ত্রী নির্ঝরিণী সরকারকে চিঠি লিখে জানালেন তাঁর সেই খুশির কথা। এরপর তাঁর মুকুটে সাহিত্যে এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কার জুটল। তখন তিনি বিশ্বকবি। স্বভাবতই জন্মদিন পালনের ঢেউ সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে আছড়ে পড়ল দেশ-বিদেশের মাটিতে।
এরকমই এক বছর বিদেশের মাটিতে কবির সম্মুখে তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়। সেটা ছিল ১৯২১ সালের ৭ মে। সুইটজারল্যান্ডের জেনেভায় বসে জন্মভূমির জন্য মন খারাপ রবীন্দ্রনাথের। চার্লস এন্ড্রুজকে লেখা চিঠিতে তিনি উল্লেখ করছেন, “তোমাদের কাছ হইতে দূরে আজিকার এই দিন আমার কাছে পুস্তিকার তারিখ মাত্র। আজ একটু নিরালা থাকিতে ইচ্ছা করিতেছি কিন্তু তাহা হইবার নাই।” সে দিন জার্মানদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল কবিকে। হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল জার্মান ভাষার কালজয়ী গ্রন্থসমূহ।
১৯৩০ সালের ২ মে রবীন্দ্রনাথের আর্জেন্টিনীয় সখা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বদান্যতায় প্যারিসের ‘গ্যালারি পিগ্যালে’ কবির আঁকা ১২৫-টি ছবির প্রদর্শনী শুরু হয়। সদ্য ৭০ বছরে পদার্পণ করা রবীন্দ্রনাথ সুদূর প্যারিস থেকে নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লিখলেন, ‘এখানে যে রবীন্দ্রনাথ আছে সে এখানকার উপকরণ নিয়ে নিজেকে একটা সম্পূর্ণতা দিয়েছে। তার সঙ্গে পঁচিশে বৈশাখের রবি ঠাকুরের মিল হবে না। দেশে ফিরে গেলে তবে আমি তাকে ফিরে পাব, সেখানকার সবকিছুর সঙ্গে।’ এরপর দেশে ফিরে এলে তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠান যেন এই প্রথম জাতীয় উৎসবে পরিণত হল। কলকাতার টাউন হলে সপ্তাহব্যপী রবীন্দ্র-জয়ন্তী পালিত হয় ‘ঠাকুর সপ্তাহ’ শিরোনামে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাগৃহে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। টাউনহলে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি ও লেখার পাণ্ডুলিপি প্রদর্শিত হয়েছিল। ইডেন গার্ডেন প্রাঙ্গণে যাত্রা, কীর্তন, জারি গান, কথকতা, রায়বেশে, দেশীয় খেলাধুলারও আয়োজন করা হয়েছিল। এতবড় আয়োজনের ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বহু ক্ষেত্রে অনেক মনোমালিন্য ও ভুল বোঝাবুঝি দেখা দিল। কবি তাঁর হতাশার কথা অমল হোমকে জানিয়েছিলেন কিছুদিন পরে– ‘অনেক পাপের জন্যই বাংলাদেশে জন্মেছি, তাই আজ সত্তর বছরে পুণ্য অর্জনে লেগে গিয়েছি মহা আড়ম্বরে জন্মোৎসব সম্বর্ধনায়।’
প্রায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল ১৯৩১ সালে কবির ৭২ তম জন্মবার্ষিকীতে। সেবার তেহরানে থাকাকালীন সেখানকার মানুষ কবির জন্মদিন উদ্যাপন করলেন হরেকরকম উপহার সাজিয়ে। ওই দিনটিতেই কবি ‘পারস্যে জন্মদিনে’ নামক কবিতায় লিখলেন– “ইরান, তোমার সম্মানমালে/ নব গৌরব বহি নিজ ভালে/ সার্থক হল কবির জন্মদিন।/ চিরকাল তারি স্বীকার করিয়া ঋণ/ তোমার ললাটে পরানু এ মোর শ্লোক,/ ইরানের জয় হোক।”
ধীরে ধীরে কবির বয়স বাড়ল। শান্তিনিকেতনে শুরু হল প্রচণ্ড দাবদাহ। গ্রীষ্মাবকাশের ছুটির কারণে কবির সম্মতি নিয়ে আশ্রমিকরা ঠিক করেন ১৯৩৬ সালের নববর্ষের দিন বর্ষবরণের পর কবির জন্মদিন পালন করা হবে। এরপর থেকে নববর্ষের দিনই শান্তিনিকেতনে কবির জন্মদিন পালিত হত। এমনকী ১৯৪১ সালের পয়লা বৈশাখেও পঁচিশের শঙ্খধ্বনি বেজেছিল। নাতি সৌমেন্দ্রনাথের দাবি রক্ষায় কবি লিখেছিলেন মানবের জয়গান, ‘ঐ মহামানব আসে’।
১৯৪১ সালে ৮০ বছরের জন্মদিনে কবি ছিলেন মংপুতে। সে দিন ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটি পাঠ করেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, “আমার জীবনক্ষেত্রের বিস্তীর্ণতা আজ আমার সম্মুখে প্রসারিত। পূর্বতম দিগন্তে যে জীবন আরম্ভ হয়েছিল তার দৃশ্য অপর প্রান্ত থেকে নিঃসক্ত দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি এবং অনুভব করতে পারছি যে, আমার জীবনের এবং সমস্ত দেশের মনোবৃত্তির পরিণতি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে...” এ দিনই তিনি লেখেন ‘জন্মদিনে’ কবিতাটি, যার শেষে ছিল, “...আজি এই জন্মদিনে/ দূরের পথিক সেই তাহারি শুনিনু পদক্ষেপ/ নির্জন সমুদ্রতীর হতে।” কে জানত কবির জীবদ্দশায় তাঁর শেষ জন্মদিন পালিত হবে এই দিনই।
তথ্যসূত্র:
পঁচিশে বৈশাখের রবি ঠাকুর, অনিতা দত্ত, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ মে, ২০২৩
৪৯ বছর বয়সে প্রথম জন্মদিন পালন ‘এখানে’

0 মন্তব্যসমূহ