নববর্ষ উদ্যাপন মানব ইতিহাসের প্রাচীনতম এবং সর্বজনীন উৎসবগুলির মধ্যে একটি। বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং ধর্ম বিভিন্ন সময়ে নতুন বছরকে চিহ্নিত করেছে সাধারণত জ্যোতির্বিদ্যা বা কৃষিজ ঘটনার উপর ভিত্তি করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ও নথিভুক্ত নববর্ষ উদ্যাপন হল আকিতু, যা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের। এই উৎসবের বিশদ বিবরণ বেশিরভাগই জানা যায় খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে লেখা কিউনিফর্ম ট্যাবলেট থেকে।
ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় নববর্ষের দিনটি জমিতে বার্লি বপন এবং পার্থিব জীবনের পুনর্নবীকরণ উদ্যাপন করার দিন ছিল। এই দিন ব্যাবিলনের সমস্ত অধিবাসীরা তাঁদের সর্বোচ্চ দেবতা মারদুক, তার পুত্র নাবু এবং অন্যান্য দেবতাদের সম্মান জানাতেন। তাঁদের মতে, এইসব দেবতারাই এক সময় ব্যাবিলন এবং তার রাজাকে রক্ষা করেছিলেন। পরবর্তীকালে ব্যাবিলনীয় ক্যালেন্ডারে, এই মাসটি ‘নিসান্নু’ নামে পরিচিত হয়। বসন্ত বিষুবের সঙ্গে মিল রেখে, এই মাসটিকে ব্যাবিলনীয় ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস হিসেবে ধার্য করা হয়। আধুনিক ইহুদি ক্যালেন্ডারে এখনও এই মাসকে ‘নিসান’ বলা হয়। আকিতু উৎসব নিসান্নু মাসের প্রথম থেকে দ্বাদশ দিন পর্যন্ত, অর্থাৎ গোটা ১২ দিন ধরে চলত। প্রতিটি দিনের নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠান থাকত; যার মধ্যে রাজা, পুরোহিত এবং ব্যাবিলনের সকল প্রজা অংশ নিতেন।
উৎসবের বিস্তারিত বিবরণে যাওয়ার আগে মারদুককে নিয়ে কয়েকটা কথা জেনে রাখা ভালো। মারদুককে প্রধানত বজ্রের দেবতা বলে মনে করা হত। ব্যাবিলনের প্রাচীন পুরাণ (এনুমা এলিস) অনুয়ায়ী এই মারদুক ছিলেন ৫০ টি দেবতা বা ঐশ্বরিক গুণের অধিকারী। আদিম অশুভ বিশৃঙ্খল দানবকে জয় করার পর তিনি স্বর্গ ও পৃথিবীর দেবতাদের প্রভু হয়েছিলেন। মানবসভ্যতা সহ সমস্ত প্রকৃতি তাঁর অস্তিত্বের কাছে ঋণী ছিল। মারদুকের নক্ষত্র ছিল বৃহস্পতি, এবং বাহন ছিল ঘোড়া, কুকুর এবং কাঁটাযুক্ত জিহ্বা সহ এক অতিকায় ড্রাগন। পারস্য দেশের বহু রাজরাজরাদের শিলালিপিতে এই মারদুকের চিত্র খুঁজে পাওয়া গেছে।
ঐতিহাসিকরা মনে করেন, এই আকিতু উৎসবটি দুটি ভাগে সম্পন্ন হত। প্রথম পর্বটি ব্যাবিলন শহরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হত। এই পর্বে ব্যাবিলনের রাজা এবং পুরোহিতরা মারদুকের বাড়ি এসাগিলা মন্দিরে এসে বলিদান এবং প্রার্থনা করতেন। দ্বিতীয় পর্বের উৎসবটি শহরের ঘেরাটোপের বাইরে একটি বিশেষ মন্দিরে উদযাপিত হত, যার নাম ছিল ‘বাইত আকিতু’ বা ‘আকিতুর বাড়ি’। এখানে এসে রাজা এবং আপামর জনসাধারণ একটি সাংস্কৃতিক উৎসবে অংশ নিতেন।
উৎসবের প্রথম তিন দিন মারদুক এবং অন্যান্য দেবতাদের প্রতি প্রার্থনা এবং নৈবেদ্য উৎসর্গ করা হত। পুরোহিতরা এই সময় দুঃখজনক বিলাপ পাঠ করে অজানা শত্রুর থেকে দেশবাসীকে সুরক্ষার জন্য মারদুকের কাছে ভিক্ষা চাইতেন। রাজা এই আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ইউফ্রেটিস নদীতে স্নান করে এসাগিলা মন্দিরে প্রবেশ করতেন।
পরবর্তী, অর্থাৎ চতুর্থ দিনটি ছিল আনন্দ ও উদ্যাপনের দিন। এসাগিলার মহাযাজক নতুন বছরের শুরুয়াত ঘোষণা করে উৎসবের সূচনা করতেন এই দিন। এসাগিলা মন্দিরে রাখা দেবতার মূর্তিগুলি নিয়ে মন্দির চত্বর থেকে শুরু করে বাইত আকিতু পর্যন্ত সঙ্গীত এবং নৃত্য সহযোগে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ও মিছিলের আয়োজন করা হত, যার নেতৃত্বে থাকতেন স্বয়ং মহারাজ। এই মিছিল চলাকালীন রাজা সর্বক্ষণের জন্য মারদুকের হাত ধরে থাকতেন এবং আরও এক বছরের জন্য তার আশীর্বাদ নিয়ে রাজসিংহাসনের কর্তৃত্ব পেতেন।
পঞ্চম দিনটি ছিল বিশ্রাম এবং উৎসবের প্রস্তুতির দিন। এই দিন পুরোহিতরা দুটি কাঠের মূর্তিকে কেটে সোনা ও রত্ন দিয়ে সাজাতেন। এই দুটি কুশপুতুল মারদুকের শত্রু তিয়ামত এবং কিংগুকের প্রতিনিধিত্ব করে, যারা বিভিন্ন সময়ে বিশ্বকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল। এই পঞ্চম দিনেই রাজা তার রাজকীয় পোশাক খুলে খালি পায়ে এসাগিলা মন্দিরে প্রবেশ করতেন। সেখানে তিনি মারদুকের একটি মূর্তির সামনে নতজানু হয়ে তার পাপ এবং ত্রুটিগুলি স্বীকার করতেন।
ষষ্ঠ দিনটি ছিল উৎসবের ক্লাইম্যাক্স। এই দিন পুরোহিতরা এনুমা এলিস আবৃত্তি করতে করতে কাঠের মূর্তিগুলির সাথে যুদ্ধ করতেন, এবং সেগুলিকে টুকরো টুকরো করে আগুনে ফেলে দিতেন। এই আচারটিকে অপশক্তির বিরুদ্ধে মারদুকের জয় এবং মহাবিশ্বে তার শৃঙ্খলার পুনর্নবীকরণের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হত।
সপ্তম দিনটি ছিল ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও উদ্যাপনের দিন। এই দিন দেবতাদের মূর্তিগুলি পরিষ্কার করে তাঁদের নতুন পোশাক পরানো হত। মারদুক এবং অন্যান্য দেবতাদের উৎসর্গ করে বিভিন্ন উপহারের ডালি তাঁদের চরণতলে রেখে আসতেন স্বয়ং মহারাজ। সাধারণ মানুষ এই দিন উৎসবে যোগ দিয়ে নানাবিধ খাওয়াদাওয়া ও মদ্যপানে মেতে থাকত। এরপর দিনের শেষে রাজা মারদুকের মূর্তি নিয়ে এসাগিলায় ফিরে যেতেন, আর নাবুর মূর্তি থেকে যেত বাইত আকিতুতেই।
অষ্টম থেকে একাদশ দিন রাজা তার পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়দের সঙ্গে তার অবসর সময় উপভোগ করতেন। ওদিকে বাইত আকিতুতে রাখা নাবুর মূর্তিকে ঘিরে উৎসবে মেতে উঠতেন সঙ্গীতজ্ঞ এবং লেখক-কবিরা।
উৎসবের শেষ দিন, অর্থাৎ দ্বাদশ দিনে রাজা বাইত আকিতু থেকে এসাগিলা পর্যন্ত দেবমূর্তির আরেকটি মিছিলে নেতৃত্ব দিতেন, যেখানে তিনি মারদুক ও নাবুকে পুনরায় একসঙ্গে মিলিত করতেন। পুরোহিতরা মারদুকের মাহাত্ম্য এবং শক্তির প্রশংসা করে বিভিন্ন প্রার্থনা এবং স্তব পাঠ করতেন। এই আচার সম্পন্ন হলে রাজা তার নিজস্ব প্রাসাদে ফিরে যেতেন, এবং মারদুকের মূর্তিটি পুনরায় তার মন্দিরে স্থাপন করা হত। কেউ কেউ বলেন, এই আচারের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে তিনি কোনো দেবতা নন। সকলের মত তিনিও ইহজগতের একজন নশ্বর মানুষ, যিনি মারদুকের অনুগ্রহ এবং সুরক্ষার উপর নির্ভরশীল।
ব্যাবিলনের ধ্বংসের পর নব্য-অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যেও আকিতু উৎসবের প্রচলন ছিল। ৬৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রাজা সেনাকেরিব নিনেভের বাইরে আরেকটি আকিতুর বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। আকিতু উৎসব সমগ্র সেলিউসিড সাম্রাজ্য জুড়ে, এমনকি রোমান সাম্রাজ্যের সময়কাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তৃতীয় শতাব্দীর শুরুতে সিরিয়ার এমেসাতে দেবতা এলাগাবালের সম্মানে পালিত হত এই উৎসব। রোমান সম্রাট এলাগাবালুস সিরিয়ার বংশোদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও ইতালিতে এই উৎসবের প্রচলন করেছিলেন।
তথ্যসূত্র:
Middle Eastern worldviews and basic religious thought




0 মন্তব্যসমূহ