আজকাল বাঙালিরা ২৫ ডিসেম্বরকে আর ‘বড়দিন’ হিসেবে মান্যতা দেয় না। বাঙালিদের কাছে এটা ‘খ্রিস্টমাস’। রাজপথ থেকে অলিগলি– ডিসেম্বরের এই কটা দিন সর্বত্র সেজে ওঠে আলোর মালায়। সকাল হতে না হতেই হোয়াটসঅ্যাপের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে পরিচিতদের শুভেচ্ছা বার্তা– ‘Merry Christmas’ অথবা ‘Merry X-mas’। আর এখানেই শুরু হচ্ছে আমাদের আসল গল্প। অর্থাৎ কোনটা সঠিক? ‘খ্রিস্টমাস’ নাকি ‘এক্সমাস’?
‘খ্রিস্টমাস’ শব্দটির উদ্ভব মধ্য ইংরেজি Christemasse ও আদি ইংরেজি Cristes mæsse শব্দ থেকে। প্রসঙ্গত, ১০৩৮ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন শহরে লিখিত একটি রচনায় সর্বপ্রথম ‘মাস’ (masse) শব্দটির লিখিত রূপ পাওয়া যায়। অনেকের মতে এই আদি ইংরেজি শব্দ Cristes mæsse খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি পবিত্র ও মহান ধর্মীয় উৎসব বলে পরিচিত। এই শব্দের অন্তর্গত ‘Cristes’ অংশটির উদ্ভব গ্রিক শব্দ Christos (মহান, অতি সম্মানীয়, বড়ো) থেকে এবং ‘mæsse’ অংশটির উদ্ভব লাতিন শব্দ missa (পবিত্র উৎসব) থেকে।
ফ্রান্সের এক শিল্পীর তুলিতে Cristes mæsse উৎসব অনুষ্ঠানযাইহোক, এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। ভাষাতত্ত্ব নিয়ে যাদের পড়াশোনা রয়েছে তাঁদের অনেকের কাছেই ‘খ্রিস্টোগ্রাম’ শব্দটি পরিচিত। এই খ্রিস্টোগ্রাম ছিল দ্বিতীয় শতকের খ্রিস্টানদের তৈরি একটি সাংকেতিক ভাষা। বিশ্বজুড়ে তখন গ্রিক ও রোমান ভাষার রমরমা। ইংরেজি ভাষা তখনও সেভাবে কর্তৃত্ব ফলাতে পারেনি। পৃথিবীর সভ্যতার গতিপথও তখন একটু একটু করে বদলাতে শুরু করেছে। এমন সময় খ্রিস্টানরা নিজেদের প্রয়োজনে এই ভাষা আবিষ্কার করে।
এরকমই একটি সংকেত ছিল ইচথাইস। খ্রিস্টোগ্রামের ভাষায় লিখলে দাঁড়ায়– IΧΘΥΣ। এর অর্থ ‘যিশু’। চতুর্থ শতকে বাইজেন্টাইনের সম্রাট প্রথম কনস্টানটাইন এই ভাষার সংস্কার করে এর একটি ভিন্ন রূপ দেন। যার ফলে ‘যিশু’ লেখা হয়ে যায়– ΧρΙΣΤΟΣ। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাষাবিদের দ্বারা এই ভাষা পরিবর্তিত হয়। পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি সময়ে থেকে ΧρΙΣΤΟΣ-র প্রথম দুটি অক্ষরকে জুড়িয়ে দিয়ে ☧ (উচ্চারণ: কাই-রো) দ্বারা খ্রিস্ট বা ক্রাইস্টকে বোঝানো শুরু হয়। ক্যাথোলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট ও অর্থোডক্স খ্রিস্টীয় গির্জাগুলিতে এই অক্ষরের ব্যবহার শুরু হয়।
কাই-রো সাংকেতিক চিহ্নএরপর বিশ্বের সভ্যতা ও সংস্কৃতির আরো একপ্রস্থ পরিবর্তন হয়। এই সময় থেকে ‘কাই-রো’-কে আরো সংক্ষেপিত করে শুধু ‘কাই’ (X) করা হয়, এবং এই কাই দিয়েই খ্রিস্ট (Christ) শব্দটি বোঝানো শুরু হয়। এর ফলে ‘Christian’, ‘Christina’ ইত্যাদি শব্দগুলির বদলে ‘Xian’, ‘Xina’ এরকম লেখার প্রচলন ঘটে। ঠিক এইভাবেই ‘Christmas’ হয়ে যায় ‘Xmas’। আনুমানিক ১৫৫০ সাল অবধি ক্রিসমাসকে বলা হত ‘X temmas’। পরবর্তীকালে সেখান থেকে আসে ‘X-mas’ (এক্সমাস) শব্দটি। যদিও অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি বলছে অন্য কথা। তাদের মতে ১৪৮৫ সাল নাগাদই এক্সমাস শব্দটির প্রয়োগ শুরু হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, ১৬৩৪ সাল নাগাদ ‘Christianity’-র পরিবর্তে ‘X-ianity’ শব্দের ব্যবহার শুরু হয়। মেরিম ওয়েবস্টারস ডিকশনারি অফ্ ইংলিশ ইউসেজ আবার বলছে এই ধরনের নতুন শব্দের প্রচলন সেইসব ইংরেজদের মধ্যে জনপ্রিয় হয় যারা উচ্চশিক্ষিত এবং গ্রিক ভাষা সম্পর্কে যাদের সম্যক ধারণা রয়েছে।
এই নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। ডেনিস ব্র্যাটখার তো সরাসরি ‘দ্য ভয়েস’ পত্রিকায় লিখে বসেন– “There are always those who loudly decry the use of the abbreviation ‘Xmas’ as some kind of blasphemy against Christ and Christianity.”
সময় পাল্টায়। পাল্টায় ভাষা। আজকের দিনে খ্রিস্টোলজি থাকলেও, ওই শব্দগুলি এখন আর ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু মজার বিষয় ‘Xmas’ এখনও টিকে আছে ক্রিসমাসের পাশে। টিকে থাকবে আজীবন!
তথ্যসূত্র:
2 মন্তব্যসমূহ
বাহ্ অসাধারণ তথ্যবহুল লেখা.. Merry Christmas to you too
উত্তরমুছুনAmazing ✨
উত্তরমুছুন