গত ১৩ জানুয়ারি বিকানির-গুয়াহাটি এক্সপ্রেসে যে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে গেল তা অনেকের মনে নতুন করে বেশ কিছু প্রশ্নচিহ্নের জন্ম দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে ভারতের বড় বড় শহরগুলিতে বুলেট ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা করেছে, সেইসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কোথাও প্যাসেঞ্জার ও এক্সপ্রেস ট্রেনগুলির রক্ষণাবেক্ষণে খামতি থেকে যাচ্ছে না তো? বছরের পর বছর একইরকম দুর্ঘটনা দেখেও কেন হুঁশ ফিরছে না আমাদের?
শুরু করা যাক ২০১৪ থেকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসার পরপরই মাননীয় নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সরকার দেশব্যপী পরিবহণ ব্যবস্থাকে উন্নত করতে একাধিক প্রকল্প ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এইসব পরিকল্পনার মধ্যে অন্যতম ছিল ভারতের মেগাসিটিগুলিতে দ্রুততম বুলেট ট্রেন চালানোর চিন্তাভাবনা।
কেমন হবে এই বুলেট ট্রেন? প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতের প্রথম বুলেট ট্রেনের জন্য মুম্বই-আমেদাবাদ রুটকে বেছে নেওয়া হয়। তৈরি করা হয় মুম্বই-আমেদাবাদ হাই-স্পিড রেল বোর্ড। মুম্বই থেকে আমেদাবাদ– এই রেলপথের দূরত্ব প্রায় ৫০৮ কিলোমিটার, যার জন্য প্রয়োজন প্রায় ১৩৯৬ হেক্টর জমি। ট্রেন চালানোর জন্য জাপানের দ্রুতগতির বুলেট ট্রেন শিনকানসেন প্রযুক্তি ব্যবহার করার কথা বলা হয়। জাপানের মত দ্রুতগতিসম্পন্ন না হলেও ভারতীয় বুলেট ট্রেনের গতি ঘণ্টায় আনুমানিক ৩২০ কিলোমিটার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩৫০ কিলোমিটার হতে পারে। এই নতুন প্রযুক্তি রপ্ত করার জন্য ভদোদারায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি আধুনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়। সবমিলিয়ে এই প্রকল্পের বাস্তবায়নে খরচ হয় মোট ১ লক্ষ ৮ হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের মধ্যে ৮৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ বার্ষিক ০.১ শতাংশ হারে প্রদান করতে উদ্যোগী হন জাপানের তৎকালীন রাষ্ট্রনায়ক শিনজো আবে।
২০১৭ সালের অক্টোবরে গুজরাতের সবরমতী স্টেশন থেকে ভারতের প্রথম বুলেট ট্রেন প্রকল্পের শিলান্যাস করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২২ সালে স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষে ভারতের প্রথম বুলেট ট্রেন চালানোর লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এসবের মাঝে বাধ সাধে করোনা মহামারী। যার ফলে বেশ কয়েক মাস প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকে। এরপর নতুন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বলা হয় ২০২৬ সালের মধ্যে মুম্বই-আমেদাবাদ রুটের একটি অংশের (সুরাট থেকে বিলিমোরা) কাজ সম্পূর্ণ হবে। অবশিষ্ট রেলপথের কাজ সম্পূর্ণ হবে ২০২৮ সালে।
এবার বুলেট ট্রেনকে সরিয়ে রেখে আসা যাক বিকানির এক্সপ্রেসের দিকে। দুর্ঘটনার ঠিক পরের দিন পরিস্থিতি পরিদর্শনে যান রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব এবং রেল ইঞ্জিনিয়ারদের একটা বড় টিম। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে অনুমান করা হয় ট্রেনের কোনো একটি যন্ত্রাংশ রেল ট্র্যাকে খুলে পড়ে (অনুমান করা হচ্ছে ট্র্যাকশন মোটর, যা ইঞ্জিনের চাকাকে রেললাইনে ধরে রাখতে ও চাকাকে ঘোরাতে সাহায্য করে), এবং বেশ কিছুটা পথ মাটির সঙ্গে ঘষা খেতে খেতে আসে। লোকোপাইলট এইধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বুঝতে পেরে এমার্জেন্সি ব্রেক কষেন, যার জেরে হুড়মুড়িয়ে বেলাইন হয়ে যায় একের পর এক কামরা।
এই অবধি ঠিক ছিল। কিন্তু এ প্রসঙ্গে আরো দুটো কথা আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। প্রথমত দুর্ঘটনাগ্রস্ত আপ বিকানির এক্সপ্রেস WAP-4 ইঞ্জিনে চলছিল। এইধরনের ইঞ্জিনে চারটি ট্র্যাকশন মোটর থাকে। প্রায় ৬-৭ বছর আগে এই ধরনের ইঞ্জিন তৈরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে রেলের সর্বত্র WAP-7 ইঞ্জিন চলে এসেছে। তাহলে এই ট্রেনটির ইঞ্জিন পরিবর্তন করা হল না কেন? দ্বিতীয়ত এই অভিশপ্ত ট্রেনের কামরাগুলো চেন্নাইয়ের ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরি (ICF)-তে তৈরি পুরোনো কোচ। অথচ বর্তমানে দেশজুড়ে ICF কোচ উৎপাদন বন্ধ করে শুধুমাত্র লিঙ্ক হফম্যান বুশ বা LHB কোচ উৎপাদন করা হচ্ছে। যেসমস্ত পুরোনো ICF কোচ রয়েছে সেগুলিও ফেজ আউট করে তুলনামূলক হাল্কা LHB কোচ বসানো হচ্ছে। তাহলে হঠাৎ করে এই ট্রেন ICF কামরায় চলার অনুমোদন পেল কীভাবে? এই বিষয়গুলি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি রেলমন্ত্রী অথবা রেল সেফটি কমিশনার। তদন্ত এখনও চলছে। ইঞ্জিনের ফরেন্সিক পরীক্ষা এখনও বাকি। যদি কোনোভাবে দুর্ঘটনার সঙ্গে পুরোনো ICF কোচ বা পুরোনো ইঞ্জিনের যোগ পাওয়া যায়, তাহলে এতগুলো প্রাণহানির দায় কি কেন্দ্রীয় সরকার নেবে?
কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীনতার আরো কয়েকটা দৃষ্টান্ত দেখা যাক। ২০২১-২২ সালে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন যে বাজেট পেশ করেন তাতে আপাতদৃষ্টিতে রেল খাতে বরাদ্দ পূর্ববর্তী বাজেটের তুলনায় বেশি হলেও প্রকৃতপক্ষে সেই অর্থ মঞ্জুর করা হয়েছে যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য, উন্নত পরিষেবা ও ট্রেনের গতি বৃদ্ধি করতে। এত বিবিধ বিষয়ের মধ্যে সরকারের চোখে এড়িয়ে গিয়েছে যে বিষয়টি, তা হল যাত্রী সুরক্ষা। ভারতবর্ষে প্রতিদিন প্রায় আড়াই কোটি মানুষ ট্রেনে যাতায়াত করেন। তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের সব থেকে বড় দায়িত্ব হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সরকার সেই কর্তব্য পালন তো করছেই না, বরং গত কয়েকমাসে আমরা দেখেছি রেলের বিভিন্ন বিভাগে কেন্দ্রীয় সরকার ঢালাও বেসরকারিকরণের পথে হেঁটেছে। এছাড়া রেলের ডেপ্রিসিয়েশন রিজার্ভ ফান্ডে (DRF) টাকা বরাদ্দ হচ্ছে না। এখানে টাকা বরাদ্দ না হলে রেলওয়ে ট্র্যাক রিপ্লেসমেন্ট ও অন্যান্য সুরক্ষার বিষয়টি নজর দেওয়া যায় না। আর ট্র্যাক ঠিক না থাকার ফলে আকছার বেলাইন হয়ে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে। সমীক্ষা অনুযায়ী, এ দেশে যতগুলি রেল দুর্ঘটনা ঘটে, তার ৫৩ শতাংশ ঘটে লাইনচ্যুত হওয়ার কারণে।
যাইহোক, দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দুটি ভিন্ন ছবি তুলে ধরলাম। একদিকে উন্নততর ‘আত্মনির্ভর’ ভারত গড়ে তুলতে দ্রুতগামী বুলেট ট্রেনের স্বপ্ন, আর অন্যদিকে সাধারণ এক্সপ্রেস ট্রেনের রক্ষণাবেক্ষণে পুরোপুরি ব্যর্থ সরকার। ফি বছর রেল খাতে বরাদ্দ বাজেটের অর্থ যে কোনোভাবেই মানুষের পরিষেবায় লাগছে না, তা একটা পরিসংখ্যান দিলেই স্পষ্ট হবে। ২০১৭ সালে বুলেট ট্রেনের আনুষ্ঠানিক শিলান্যাস করার পরেও প্রায় প্রত্যেক বছর একটি করে বড়ো রেল দুর্ঘটনার সাক্ষী থেকেছে গোটা দেশ। এগুলির কোনোটা ঘটেছে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে, আবার কোনোটা ঘটেছে রেল আধিকারিকদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে। নীচে সেরকম কতগুলি বড়ো দুর্ঘটনার সন তারিখ উল্লেখ করলাম। বলা বাহুল্য এর বাইরেও একাধিক ছোটোখাটো দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় বহু মানুষ, যেগুলি সচরাচর সেভাবে সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে আসে না।
- ১০ অক্টোবর, ২০১৮: উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলিতে নিউ ফারাক্কা এক্সপ্রেসের ছটি কামরা লাইনচ্যুত। ৬০ জনেরও বেশি যাত্রী জখম, ৭ জনের মৃত্যু।
- ১৯ অক্টোবর, ২০১৮: পাঞ্জাবের অমৃতসরে দশেরা উৎসব পালনের সময় রেললাইনে থাকা স্থানীয় বাসিন্দাদের পিষে দিয়ে চলে যায় একটি লোকাল ট্রেন। ঘটনাস্থলে ৫৯ জনের মৃত্যু। আহত শতাধিক।
- ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯: বিহারের পাটনায় লাইনচ্যুত হয় সীমাঞ্চল এক্সপ্রেস। ৭ জনের মৃত্যু।
- ২২ জুলাই, ২০২০: হায়দ্রাবাদের স্টেশনের মাঝামাঝি ট্র্যাকে কাজ চলাকালীন হঠাৎ ঢুকে পড়ে একটি ডবল ইঞ্জিন ট্রেন। আহত ৯ রেলকর্মী (কর্তব্যরত), মৃত্যু ৩।
- ২৫ অগাস্ট, ২০২১: হাওড়াগামী সরাইঘাট কোভিড স্পেশাল ট্রেনের প্যান্ট্রি কার সমেত চারটি কোচ লাইনচ্যুত হয় ছয়গাঁও স্টেশনে।
অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে বাজেটে বরাদ্দ অর্থ বৃদ্ধি পেলেও যাত্রীদের সুরক্ষায় সেভাবে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি রেলমন্ত্রক। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন প্রযুক্তি, নতুন প্রকল্পের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু পুরোনোকে অবহেলা করে নয়। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দ্রুতগতির বুলেট ট্রেন অনেক পরের প্রশ্ন। তার আগে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের নিরাপত্তার প্রতি নজর দিতে হবে মানবিক সরকারকে। আর বাংলার প্রতি কেন্দ্রের বিভিন্ন বঞ্চনা তো আজকাল গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবর্ষের পিঙ্ক বুক দেখলেই বোঝা যাবে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের বহু ট্র্যাক রিনিউয়াল প্রকল্পে নামমাত্র বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে। ওল্ড মালদহ-কুমেদপুরের ১২.২০ কিমি ট্র্যাক নবীকরণেও বরাদ্দ তথৈবচ। পূর্ব রেল ও দক্ষিণ-পূর্ব রেলের হালও এক। পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী বাজেটে রেল সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হবে কি? সেই তালিকায় ট্র্যাক রিনিউয়ালও থাকবে কি? সেটাই এখন জনতার কাছে লাখ টাকার প্রশ্ন।
1 মন্তব্যসমূহ
একদম তাই! খুব ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন