সময়টা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক। জমিদারির কাজ তদারকি করতে শান্তিনিকেতন থেকে নয়গাঁওয়ের পতিসরে এসেছেন এক বাবুমশাই। ভদ্রলোকের সুঠাম চেহারা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, চাপ দাড়ি। পতিসরের কাছারিবাড়িতে উঠেই ভদ্রলোক খোঁজ করতে লাগলেন জমিদারবাড়ির এক সেরেস্তার। নাম হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কাছারিবাড়িতে তখন সে এক উৎসবমুখর পরিবেশ। এর-ওর মারফত খবর পেয়ে হরিচরণ যখন বাবুর ঘরে প্রবেশ করলেন, তিনি স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন তাঁর সামনে বসে রয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। হরিচরণকে কাছে ডেকে সেদিন রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘দিনে তো সেরেস্তায় কাজ করো, রাতের বেলা কী করো তুমি?’’ উত্তরে হরিচরণ বলেছিলেন, ‘‘সন্ধ্যার পর কিছুক্ষণ সংস্কৃতের আলোচনা করি। তারপর কিছুক্ষণ বইয়ের পাণ্ডুলিপি দেখে প্রেসের কপি-পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করি।’’
এই ঘটনার কদিন পরে পতিসরের ম্যানেজার শৈলেশচন্দ্র মজুমদারের কাছে রবীন্দ্রনাথের হাতে লেখা একটি নোট আসে। তাতে বলা ছিল, ‘‘শৈলেশ, তোমার সংস্কৃতজ্ঞ কর্মচারীকে এইখানে পাঠাইয়া দাও।’’ ‘এইখান’ অর্থাৎ শান্তিনিকেতনে গিয়ে বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন, জগদানন্দ রায়ের মত অধ্যাপক এবং ঠাকুর পরিবারের জ্ঞানী-গুণী দিকপালদের সঙ্গে একই সারিতে ঠাঁই হয় হরিচরণের।
শান্তিনিকেতনে ছাত্রকুলের মাঝে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়হরিচরণ-রবীন্দ্রনাথের আলাপ যে এটাই প্রথমবার এমনটা নয়। এর আগেও ঠাকুরবাড়ির একটি নাটকে দুজনের মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়েছিল। তার জন্য অবশ্যই অনেকটা দায়ী ছিলেন যদুনাথ চট্টোপাধ্যায়। হরিচরণের বয়স তখন পনেরো কী ষোলো। দাদা যদুনাথের হাত ধরে সেবার ঠাকুরবাড়িতে নাটক দেখতে গিয়েছিলেন হরিচরণ। নাটকের নাম ‘বাল্মীকি প্রতিভা’। অভিনয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। আর এইভাবেই, নাটকের সূত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হরিচরণের প্রথম পরিচয়।
যাইহোক, আবার ফিরে আসি শান্তিনিকেতনে। ইতিমধ্যেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হরিচরণের এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। শান্তিনিকেতনে প্রায় বছর তিনেক অধ্যাপনা করার পর একদিন অকস্মাৎ রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে একটি প্রস্তাব পান তিনি। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “শোন হরিচরণ, আমার একটি নির্দেশ পালন করতে হবে তোমাকে। তুমি একটি ‘সংস্কৃত' প্রবেশ’ রচনা করবে। আমি তোমাকে একটি পাণ্ডুলিপি দেব। সেই পাণ্ডুলিপির প্রণালী অনুসারেই তুমি ‘সংস্কৃত প্রবেশ’ লিখবে।” লেখা শুরু করার পর তিন খন্ডে যখন সংস্কৃত প্রবেশ রচনার কাজ প্রায় শেষ, তখন রবীন্দ্রনাথ এলেন আর একটি অনুরোধ নিয়ে। তাঁর ইচ্ছা হরিচরণ যেন বাংলা ভাষায় একটি অভিধান রচনা করেন। কারণ এর আগে সেই সময় বাংলা ভাষার কোনো উপযুক্ত অভিধান ছিল না। রবীন্দ্রনাথের মুখে এমন কথা শুনে হরিচরণ কিছুটা বিস্মিত হন। রবীন্দ্রনাথের মত একজন গুণী মানুষের কাছ থেকে কোনো অনুরোধ এলে তা তো আর অমান্য করা যায় না। অতএব দিন-রাত এক করে শুরু হল অভিধানের খসড়া তৈরির কাজ। তাঁর উদ্যোগ দেখে খুশি হয়ে রবীন্দ্রনাথ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিপাঠীকে লিখেছিলেন, ‘‘এ গ্রন্থখানি রচিত ও প্রকাশিত হইলে দেশের একটি মহৎ অভাব দূর হইবে।’’
অভিধান রচনার কাজ দিব্যি চলছিল জানেন! কিন্তু হঠাৎই এক সময় হরিচরণের বাড়িতে প্রবল অর্থসঙ্কট দেখা দেয়। অভিধান রচনার কাজ একা হাতেই পুরোটা সামলাচ্ছিলেন হরিচরণ। না ছিল কোনো সহকারী, না পেতেন কোনো অর্থসাহায্য। সেই কয়েকটা মাস টাকাপয়সার এমন টানাটানি চলছিল, যে হরিচরণকে একপ্রকার বাধ্য হয়ে শান্তিনিকেতন ছাড়তে হয়। সেন্ট্রাল কলেজের ক্ষুদিরাম বসুর সাহায্যে হরিচরণ কলকাতায় একটি চাকরি পান। ওই কলেজেই সংস্কৃত পড়ানোর চাকরি। কলকাতায় এসে হরিচরণ ছাত্রদের সংস্কৃত পড়াতে লাগলেন ঠিকই। কিন্তু তাঁর মন পড়ে রইল আশ্রমে। এদিকে আবার অভিধানের কাজটিও এগোচ্ছে না। সব মিলিয়ে প্রচণ্ড মানসিক পীড়ায় ভুগতে লাগলেন হরিচরণ।
শেষমেষ হরিচরণকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন রবীন্দ্রনাথ। হরিচরণকে তিনি নিয়ে গেলেন কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর কাছে। রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র হরিচরণকে জিজ্ঞেস করলেন, “কতদিন লাগবে এই অভিধান শেষ করতে?” হরিচরণ জানান, “অন্তত ন বছর।” রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র মাসিক পঞ্চাশ টাকা করে বৃত্তি দিতে সম্মত হলেন। মাসিক পঞ্চাশ টাকার এই বৃত্তি হরিচরণ পেয়েছিলেন প্রায় আট বছর। আর তার পরের চার বছর মিলেছিল ষাট টাকা করে বৃত্তি।
বৃত্তি পেয়েই হরিচরণ ফিরে যান শান্তিনিকেতনে। প্রায় দু দশকের প্রচেষ্টায় তিনি অভিধানের পাণ্ডুলিপি লেখার কাজ সম্পূর্ণ করেন। অভিধান তৈরির সময় হরিচরণের শ্রম ও নিষ্ঠার কাহিনী যে কী বিচিত্র, সুরঞ্জন ঘোষ একটি লেখায় তার বর্ণনা দিয়েছেন– “প্রতিদিন সান্ধ্য আহ্নিক সেরে লন্ঠনের আলোয় কুয়োর ধারে খড়ের চালাঘরে পশ্চিম জানলার কাছে হরিবাবু কাজ করতেন।” হরিচরণের ছাত্র হওয়ার সুবাদে তাঁকে সামনে থেকে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিলেন প্রমথনাথ বিশীও। তাঁর কথায়– “সকালে ঘুম থেকে উঠেই হাঁটতে যেতেন। তারও একটা সীমানির্দেশ ছিল– তালগাছ পর্যন্ত। তার পর থেকে প্রতিটি মুহূর্ত যেন নিয়মের বেড়িতে বাঁধা। হেঁটে ফিরে জলখাবার। জলখাবারের তালিকাটিও ভীষণ সাদামাঠা। মুড়ি, দুধ আর সামান্য কিছু ফল। তারপর লাইব্রেরিতে পড়াশোনা। ফিরে এসে দুপুরের খাওয়া। নিরামিষ। পাতে একটা জিনিস থাকা চাই-ই– তেঁতুলের জল। দুপুরের খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম। সেই সময় তাঁকে খবরের কাগজ পড়ে শোনানো হত। প্রতিদিন আহ্নিকের পরে ‘শ্রীমদ্ভাগবতগীতা’র কয়েকটি অধ্যায় পড়া ছিল তাঁর অভ্যাস। বৃদ্ধ বয়সে যখন চোখের দৃষ্টি প্রায় চলে গিয়েছে, তখনও এই অভ্যাসটিতে ছেদ পড়েনি। রাতের খাওয়া আটটার মধ্যে শেষ করে নিতেন। বিলাসিতা ছিল একটাই। খাবার শেষে এক খিলি পান। পান না হলে তাঁর চলত না।”
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিতেও এই ‘ক্ষীণপ্রায় ব্রাহ্মণ’-এর ছবিটা প্রায় একইরকম। সুনীতিবাবু যখনই হরিচরণের বাড়ি যেতেন, তখনই দেখতেন তক্তপোষের উপর স্তূপ করে রাখা উর্দু, পার্সি, ইংরেজি, ওড়িয়া, মারাঠি-সহ বিভিন্ন ভাষার অভিধান। আর তার মাঝে মাথা গুঁজে নিজের কাজ করে চলেছেন হরিচরণ। এই দৃশ্য দেখে দ্বিজেন ঠাকুর তো ছড়াই বেঁধে ফেলেছিলেন, ‘‘কোথা গো মেরে রয়েছ তলে/ হরিচরণ, কোন গরতে?/ বুঝেছি, শব্দ-অবধি-জলে/ মুঠাচ্ছ খুব অরথে।।’’
যাইহোক পাণ্ডুলিপির প্রাথমিক কাজ শেষ। এরপর শুরু হল বই ছাপার প্রক্রিয়া। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে বিশ্বভারতী থেকেই প্রকাশ হোক এই মহাগ্রন্থটির। কিন্তু সেই সময় বিশ্বভারতীর কোষাগারের বেহাল অবস্থা। কবিগুরুর নির্দেশে দীনেশচন্দ্র সেন ও সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় গেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার জানিয়ে দিলেন ছাপার জন্য লাগবে হাজার পঞ্চাশেক টাকা। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট-সদস্য। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও কোনোরকম সাহায্য করতে পারলেন না। এরপর তাঁরা যান বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের কোষাধ্যক্ষ অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের কাছে। এদিকে তখন পরিষদের কোষাগারেরও বেহাল অবস্থা। তাই বাধ্য হয়ে অমূল্যবাবুও তাঁদের ফিরিয়ে দেন।
প্রায় দশটা বছর পাণ্ডুলিপি পড়ে রইল হরিচরণের ঘরে। এর মধ্যে অন্তত দুবার প্রুফ চেকিং করে যাবতীয় ভুলভ্রান্তি সংশোধন করে নেন হরিচরণ। ওদিকে বই কীভাবে ছাপা হবে সেই নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় গোটা শান্তিনিকেতন। মাঝেসাঝেই আলোচনায় বসছেন রবীন্দ্রনাথ, রথীন্দ্রনাথ ও সুনীতিকুমার। শেষ পর্যন্ত অবশ্য প্রকাশক পাওয়া গেল। ‘বিশ্বকোষ’-এর নগেন্দ্রনাথ বসু জানালেন, তিনি এই বই প্রকাশ করতে চান, তবে শর্তমাফিক কাগজের দামটা তখনই দিয়ে দিতে হবে। ছাপার খরচটা পরে দিলেও চলবে। হরিচরণ নিজের সবটুকু সঞ্চয় দিয়ে দিলেন বই প্রকাশের কাজে। তারপর একে একে ১৩ বছর ধরে মোট ১০৫ খণ্ডে প্রকাশিত হতে শুরু করল বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম অভিধান ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’।
বঙ্গীয় শব্দকোষের প্রথম সংস্করণগুরুদক্ষিণা হিসেবে হরিচরণ রবীন্দ্রনাথকে অর্পণ করেছিলেন তাঁর ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’। দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছরের পরিশ্রমের শেষে এক সময় দৃষ্টিশক্তি চলে যায় তাঁর। হরিচরণের তা নিয়ে কোনও আক্ষেপ ছিল না। বরং তাঁকে বলতে শোনা যেত, “গুরুদেবের কাজে নিজের চোখ দুটো উৎসর্গ করতে পেরেছি, এটাই পরম সান্ত্বনা।”
বিশ্বভারতী কোনও কমিশন ছাড়াই অভিধান বিক্রির ব্যবস্থা করে। অর্থসাহায্য করেন রথীন ঠাকুর, নাড়াজোলার মহারাজা, আশ্রমিক সঙ্ঘ, বিশ্বভারতী সংসদ কর্তৃপক্ষ। সেই সময়কার পত্র-পত্রিকাগুলি তখন ধন্য ধন্য করছে হরিচরণের। মহাত্মা গান্ধী তাঁর হরিজন পত্রিকায় হরিচরণকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গিলবার্ট মারের সঙ্গে তুলনা করলেন। বিশিষ্ট সাহিত্যিক রাজশেখর বসু লিখলেন– “বঙ্গীয় শব্দকোষে প্রাচীন ও আধুনিক সংস্কৃতেতর শব্দ (তদ্ভব দেশজ বৈদেশিক প্রভৃতি) প্রচুর আছে। কিন্তু সংকলয়িতার পক্ষপাত নাই, তিনি বাঙলা ভাষায় প্রচলিত ও প্রয়োগযোগ্য বিশুদ্ধ সংস্কৃত শব্দের সংগ্রহে ও বিবৃতিতে কিছুমাত্র কার্পণ্য করেন নাই। যেমন সংস্কৃত শব্দের ব্যুৎপত্তি দিয়াছেন, তেমনি অসংস্কৃত শব্দের উৎপত্তি যথাসম্ভব দেখাইয়াছেন।” সব মিলিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তখন এক তুমূল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
--
১৯৫৯ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু হরিচরণ ছিলেন শান্তিনিকেতনেরই বাসিন্দা। হরিচরণের মৃত্যুর পর ১৯৬৬ ও ১৯৬৭ সালে দু’খণ্ডে গোটা অভিধানটি প্রকাশ করে সাহিত্য অ্যাকাডেমি। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তিনি রচনা করে গেছেন একাধিক গ্রন্থ, যা বর্তমানে বাংলা ভাষার গবেষণা ও সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য ও মূল্যবান। তাঁর রচিত ‘কবির কথা’, ‘রবীন্দ্রনাথের কথা’; অনূদিত গ্রন্থ ম্যাথু আর্নল্ডের ‘সোরাব রোস্তম’ এবং ‘বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র’, ‘কবিকথা মঞ্জুষা’; ছাত্রপাঠ্য গ্রন্থ ‘সংস্কৃত প্রবেশ’, ‘পালি প্রবেশ’, ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’, ‘হিন্টস অন সংস্কৃট ট্রান্সশ্লেষন অ্যান্ড কম্পোজিশন’ ইত্যাদি আজকের দিনেও সমান স্বীকৃত। অনূদিত গ্রন্থগুলির অধিকাংশই অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত। আর এইসব গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন ‘দেশিকোত্তম’, বিশ্বভারতীর ডি–লিট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক, শিশিরকুমার স্মৃতি পুরস্কার প্রভৃতি।
তথ্যসূত্র:
1 মন্তব্যসমূহ
বাহ্, অনেক নতুন তথ্য জানতে পারলাম।
উত্তরমুছুন