ত কয়েক দশকে মানবসভ্যতার উন্নয়নে যে কটি নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন হয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artifical Intelligence) নিঃসন্দেহে তার মধ্যে অন্যতম। শিক্ষা, শিল্প, চিকিৎসা সর্বত্র এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও যান্ত্রিক রোবটদের আধিপত্য। তবে ভেবে দেখতে গেলে, আজকের জমানায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আমরা যতই মাতামাতি করি না কেন, সাহিত্যের পাতায় অবশ্য অনেক আগেই এর আবির্ভাব ঘটে গেছে। বাংলা কল্পবিজ্ঞানে প্রায় দেড়শো বছরের ইতিহাস ঘাঁটলেই বোঝা যায় পাঠকদের চাহিদা পূরণ করতে হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সত্যজিৎ রায়, অনীশ দেব থেকে শুরু করে রেবন্ত গোস্বামী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কিংবা আজকের জমানার সৈকত মুখোপাধ্যায়, অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীর মত গুণী লেখকরা বারবার নিজেদের গল্পে নিয়ে এসেছেন যন্ত্রমানবদের। বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসে এই যন্ত্রমানবরাই যে একদিন সভ্যতার ইতিহাস পাল্টে দেবে তাই বা তখন কে জানত!

এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে তৈরি আরেকটি মোক্ষম অস্ত্র বর্তমানে প্রায় সমস্ত বিশ্ববাসীর হাতের মুঠোয় ঘুরপাক খাচ্ছে। চ্যাট জিপিটি। গুমোট পরিবেশের মাঝে প্রচণ্ডভাবে একলা হয়ে যাওয়া মানুষটা আজ সমাধানের জন্য ছুটে যায় চ্যাট জিপিটির কাছে। এক চিলতে রোদের অপেক্ষায় থাকা প্রেমিকও আজ মনের কথা বলে চ্যাট জিপিটিকে। ঘরকুনো বাঙালি হয়ে গেছে আরও ঘরকুনো, বা বলা ভালো ফোনকুনো। নিজের থেকেও আজ যেন আমরা বেশি বিশ্বাস করি তরতরিয়ে লিখে যাওয়া এই প্রযুক্তিকে।

চ্যাট জিপিটি: আমাদের মুশকিল আসান

সত্যি বলতে চ্যাট জিপিটি আসার পরে আমাদের অনেক দূরুহ কাজও এখন সহজ বলে মনে হয়। বিজ্ঞানর ভাষায় যাকে বলে bot, অর্থাৎ মানুষের চাহিদা বুঝে সেই অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন এই ধরনের প্রযুক্তি আগেও হয়ত ছিল। কিন্তু চ্যাট জিপিটির মত একেবারে বিনামূল্যে এত বৃহৎ পরিসরে কাজ করার ক্ষমতা বোধহয় এর আগে লক্ষ্য করা যায়নি। বসের মন জয় করে সামনের মাসে প্রমোশন পেতে হবে? নো টেনশন। চ্যাট জিপিটি করে একটা সুন্দর পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বানিয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিন। পরীক্ষার আগের রাতে বিশাল সিলেবাসের সমুদ্রে ডুবে হাবুডুবুর দিনও শেষ। শুধু গোটাকয়েক বিষয়ের নাম লিখে চ্যাট জিপিটিকে আদেশ দিন, মুহূর্তের মধ্যে সে সেইসব বিষয়ের প্রধান প্রধান কনসেপ্টগুলো সুন্দরভাবে আপনার সামনে পেশ করে দেবে। বন্ধুর জন্মদিনে তাকে কী উপহার দিলে সে খুশি হবে বুঝতে পারছেন না? এক্ষেত্রেও বন্ধুর পছন্দের বিষয়গুলির তালিকা তুলে ধরলে চ্যাট জিপিটি আপনাকে সাহায্য করতে পারে। এই উদাহরণগুলো কিন্তু শুধু এখানেই থেমে নেই। যত দিন যাচ্ছে, নিত্যনতুন বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হচ্ছে নতুন নতুন চ্যাট জিপিটি মডেল।

বর্তমানে আমরা যে চ্যাট জিপিটি ব্যবহার করছি তা তৈরি করা হয়েছে জেনারেটিভ প্রিট্রেইনড ট্রান্সফরমার ৪ (জিপিটি-৪) এর উপর ভিত্তি করে। ইন্টারনেটে থাকা ওয়েব পেজ, ওয়েব টেক্সট, বই, উইকিপিডিয়া, প্রবন্ধ সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রায় ৫৭০ জিবির বেশি তথ্য নিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে এই চ্যাট জিপিটি। শুধু তাই নয়, এই চ্যাট বটে রয়েছে ৩০০ বিলিয়ন শব্দের ভাণ্ডার। পাশাপাশি এটি একটি বাক্য শেষ হওয়ার পর তার পরবর্তী বাক্যটি কী হওয়া উচিত তা অনুমান করতেও সক্ষম।

এখন হাতের সামনে এরকম একটি পরশপাথরের সন্ধান পেলে কেই বা চাইবে তার প্রতি অবজ্ঞা দেখাতে। সুতরাং একবারের জন্য হলেও, সে অর্থে কোনো প্রয়োজন না থাকলেও, নিতান্ত নিজের কৌতূহল নিবৃত্তির উদ্দেশ্যেও আমরা কখনও না কখনও ব্যবহার করেছি এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে। আর এখানেই আমরা ডেকে এনেছি নিজেদের সর্বনাশ।

একটু খুলে বলা যাক। এর শুরুটা হয়েছিল গত এপ্রিলের মাঝামাঝি প্রকাশ পাওয়া একটি গবেষণাপত্রের হাত ধরে। গবেষণাপত্রটির মূল লেখক লি পেংফেই রিভারসাইড ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তাঁর এই গবেষণাপত্রের সারমর্ম এই যে, আর পাঁচটা প্রযুক্তিগত কোম্পানির জলীয় পদাঙ্কের (জলীয় পদাঙ্ক অর্থাৎ water footprint হল কোনো একটি উৎপাদিত সামগ্রী প্রস্তুত হতে যে পরিমাণ জলের প্রয়োজন তার পরিমাপ) তুলনায় চ্যাট জিপিটির জলীয় পদাঙ্ক অনেকগুণ বেশি। সোজা ভাষায় সমগ্র ব্যবস্থাপনাকে সুষ্ঠুভাবে চালনা করার জন্য প্রয়োজন অবিচ্ছিন্ন জলধারার। ১-২ লিটার জল নয়, লক্ষ লক্ষ লিটারের জলও এর পিপাসা মেটাতে অপর্যাপ্ত।

জলপিপাসা: প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ জলীয় পদাঙ্ক (পেংফেইয়ের গবেষণাপত্র থেকে সংগৃহীত)

এত বিশাল পরিমাণ জলের প্রয়োজনীয়তাকে দুভাগে ভাগ করে বোঝানো যেতে পারে। প্রথমত, এই ব্যবহৃত জলের একটা বড় অংশ কাজে লাগে ডেটা সেন্টারের সিস্টেমকে ঠাণ্ডা রাখার জন্য। গুগল, মাইক্রোসফ্ট বা এই জাতীয় বড় বড় কোম্পানিগুলোর মত এখানেও যে বিশাল বিশাল যন্ত্রপাতিগুলো অনবরত কাজ করে চলছে, সেখান থেকে উৎপাদিত তাপশক্তিকে প্রশমিত করতে জলের প্রয়োজন হয়। এখানে বলে রাখা ভালো, সিস্টেমের ক্ষয়, অথবা জীবাণুর বংশবৃদ্ধি রোধ করার জন্য এখানে কেবলমাত্র পরিশ্রুত স্বাদুজলের ব্যবহার করা হয়। ওপরের ছবিটির দিকে (On-site water consumption) তাকালে বোঝা যাবে, দু ধরণের চক্র চলতে থাকে: একটি আবদ্ধ চক্র, এবং অপরটি উন্মুক্ত চক্র। পরিশ্রুত জলধারা শীতাতপ যন্ত্র হয়ে বেরিয়ে একবার ডেটা সেন্টারে প্রবেশ করলে, বৃত্তাকারে আবদ্ধ চক্রের মধ্যে দিয়ে পুনরায় তা ডেটা সেন্টারে ফিরে যেতে পারে। অপরদিকে, মূলত জলের খনিজ পদার্থের নিঃসরণের উদ্দেশ্যে যে উন্মুক্ত চক্রের প্রয়োজন হয়, তা কুলিং টাওয়ার থেকে ব্যবহৃত জল বাষ্পাকারে পরিবেশে ফিরিয়ে দেয়। 

এছাড়া ব্যবহৃত জলের আরেকটি অংশ কাজে লাগে ডেটা সেন্টারে প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদনের জন্য। কয়লা পুড়িয়ে তাপশক্তি উৎপাদনে যে পরিমাণ খরচ এবং পরিবেশের ক্ষতি, তাকে এড়িয়ে চলার জন্য এখানে ব্যবহার করা হয় অচিরাচরিত শক্তির উৎস। কাছাকাছি থাকা জলের কোনো উৎস থেকে জল পাম্প করে টারবাইন ঘুরিয়ে প্রস্তুত করা হয় জলবিদ্যুৎ। সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে মোটামুটি ১ কিলো-ওয়াট-ঘণ্টা (kWh) শক্তি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন হয় ১.৮ লিটার জলের। প্রযুক্তির ভাষায় এই গোটা ঘটনাটির পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে ওয়াটার ইউসেজ এফেক্টিভনেস (WUE)। এর পাশাপাশি ডেটা সেন্টারে ব্যবহৃত অর্ধপরিবাহী, যা কিনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা স্থাপনকারী অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তার উৎপাদনের ক্ষেত্রেও পরিশুদ্ধ স্বাদুজলের প্রয়োজন হয়।

পেংফেইয়ের গণনা অনুযায়ী, গড়ে ২০ থেকে ৫০ টি প্রশ্নের উত্তর দিতে মূল সিস্টেম যতটা শক্তি উৎপাদন করে, তাকে প্রশমিত করতে ৫০০ মিলিলিটার জলের প্রয়োজন। আপাতদৃষ্টিতে ৫০০ মিলিলিটার জলকে তুচ্ছ মনে হলেও গোটা বিশ্বের কোটি কোটি ব্যবহারকারীর নিরিখে এই সংখ্যাটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। দেখা গেছে জিপিটি-৩ চালানোর জন্য মার্কিন ডেটা সেন্টারে প্রয়োজন হয় প্রায় ৩৫ লক্ষ লিটার পরিশ্রুত স্বাদুজলের। এর সমপরিমাণ শক্তি কাজে লাগালে নাকি প্রায় ৩০০০ বি.এম.ডব্লিউ. গাড়ি এবং প্রায় ২৫০০ টেসলা ইলেকট্রনিক যান প্রস্তুত করা সম্ভব হত। একই ধরনের গণনা এশিয়ার ডেটা সেন্টারের ওপরেও করার পর বোঝা যায় এশিয়ার ক্ষেত্রে এই জলের পরিমাণটা প্রায় ৪৯ লক্ষ লিটার।

পেংফেইয়ের গবেষণাপত্র বাজারে আসার দিন পনেরো বাদে চেন্নাইয়ের শাজি জর্জ ও তাঁর দুই সহকারী অনুরূপ গবেষণার ভিত্তিতে আরেকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, যা পরোক্ষে পেংফেইয়ের ধারণাকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। শুধু তাই নয়, এই বিপুল পরিমাণ জলরাশি প্রতিনিয়ত ভূপৃষ্ঠ থেকে উধাও হতে থাকলে পরিবেশের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে তাও এই গবেষণাপত্রের লেখকত্রয় বুঝিয়ে গেছেন। এই বিপুল পরিমাণ জলরাশি ব্যবহার করার ফলে প্রথমেই যা হতে পারে তা হল জলসংকট। যেহেতু সিস্টেমের যন্ত্রপাতি সচল রাখার জন্য শুধুমাত্র স্বাদুজলেরই প্রয়োজন হয়, তাই স্থানে স্থানে লেক বা নদীর জল ব্যবহারের ফলে তার জলস্তর কমে যেতে পারে। এই জলস্তর কমে যাওয়ার ফলে বিভিন্ন জায়গায় খরার প্রকোপ বাড়তে পারে, কৃষিক্ষেত্রে অথবা পানীয় জলের সংকটও দেখা দিতে পারে। এর সার্বিক প্রভাব পড়তে পারে জলজ বাস্তুতন্ত্রের ওপরেও। এর পাশাপাশি কুলিং টাওয়ারে বারবার চক্রাকারে জলের পরিবহন হতে থাকলে স্বাভাবিক ভাবেই সৃষ্টি হবে বিশাল পরিমাণ বর্জ্য পদার্থ। ফলে সব মিলিয়ে এও হবে এক নতুন মাথাব্যথার কারণ।

এখন এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? চ্যাট জিপিটি যেমন মানবসভ্যতার যাত্রাপথের এক অনন্য আশীর্বাদ, তেমনি এই তীব্র জলপিপাসা মেটানোর দায়িত্বও আমাদেরই নিতে হবে। এই সমস্যা দূর করতে হলে সর্বপ্রথম, ডেটা সেন্টারে ব্যবহৃত শক্তির পরিমাণ কমাতে হবে। দরকার পড়লে মূল সিস্টেমের সঙ্গে থাকা অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। তুলনায় কম তাপ উৎপাদনকারী হার্ডওয়্যারকে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, জলের ব্যবহার করে তাপমাত্রা প্রশমিত করার পরিবর্তে আধুনিক কোনো ব্যবস্থার সন্ধান করতে হবে। প্রয়োজনে ব্যবহৃত জল পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। তৃতীয়ত, পরিবেশগত দিক দিয়ে ভবিষ্যতে এমন জায়গায় ডেটা সেন্টার স্থাপন করা উচিত যেখানকার আবহাওয়া হবে শীতল, এবং স্বাদুজলের উৎস থাকবে কাছাকাছি কোনো স্থানে। চতুর্থত, নিয়মিত জলের ব্যবহার ও জলীয় পদাঙ্ক হিসেব রাখার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত জল খরচ হলে আগেভাগে তা মোকাবিলা করা যেতে পারে।

তথ্যসূত্র:

Pengfei Li, Jianyi Yang, Mohammad A Islam, and Shaolei Ren. 2023. Making AI Less" Thirsty": Uncovering and Addressing the Secret Water Footprint of AI Models. arXiv preprint. https://doi.org/10.48550/arXiv.2304.03271
A. Shaji George, A. S. Hovan George, & A. S. Gabrio Martin. 2023. The Environmental Impact of AI: A Case Study of Water Consumption by Chat GPT. Partners Universal International Innovation Journal (PUIIJ), 01(02), 91–104. https://doi.org/10.5281/zenodo.7855594
AI chatbots may be fun, but they have a drinking problem, The Times of India, May 31, 2023.
ChatGPT is consuming a staggering amount of water
বঙ্গদেশের যন্ত্রমানব