চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য অথবা গবেষণার কাজে দেহদানের কথা আমাদের কারোরই অজানা নয়। কিন্তু মঞ্চে নিখুঁত অভিনয়ের জন্য থিয়েটার-পাগল কোনো ব্যক্তির দেহ অথবা দেহাংশ দানের ঘটনা আজকের দিনেও নজিরবিহীন। ফিলাডেলফিয়ার জন ‘পপ’ রিড, পোল্যান্ডের আন্দ্রে চেকভস্কি, শিকাগোর ডেল ক্লোজ– এ তালিকায় থাকা প্রত্যেকেই চেয়েছিলেন থিয়েটারের জন্য কিছু করে যেতে। প্রত্যক্ষভাবে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও শুধুমাত্র থিয়েটারকে ভালোবেসে তাঁদের এই আত্মত্যাগ গোটা বিশ্বের কাছে রয়ে গেছে এক বিরল দৃষ্টান্ত রূপে।

তবে এনাদের সকলের মধ্যে যে নামটি এখনও অবধি সবচেয়ে বেশি চর্চিত, তিনি হলেন আন্দ্রে চেকভস্কি (Andre Tchaikowsky), জন্মসূত্রে যাঁর নাম ছিল রবার্ট আন্দ্রেজ ক্রাউথমার। ১৯৪২ সালে পোল্যান্ডে যখন একের পর এক ইহুদি পরিবারের ওপর অত্যাচার চলছে, ঠিক সেরকম সময়ে ওয়ারশের একটি পরিবারে রবার্ট আন্দ্রেজ ক্রাউথমারের জন্ম। নিরাপত্তার কারণে নাৎসিদের অভিশাপ থেকে বাঁচতে তাঁর মা সন্তানের নাম ক্রাউথমার থেকে পরিবর্তন করে রাখেন আন্দ্রে চেকভস্কি। ছেলেবেলা থেকেই তিনি অনুভব করেন সুরেলা সঙ্গীত ও সুরেলা যন্ত্রের প্রতি তাঁর আকর্ষণের কথা। যুদ্ধের সাইরেন উপেক্ষা করে পিয়ানোর রিডে আঙুল বুলিয়ে তিনি নিজেকে তুলে ধরেন বিশ্বের অন্যতম সেরা পোলিশ সুরকার হিসেবে। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের সাতটি সনেটে সুর ও কণ্ঠস্বর দেন চেকভস্কি একাই।

যুদ্ধ যত এগিয়েছে, স্বজনহারার শোক যত বিদীর্ণ করেছে পোল্যান্ডের আকাশ-বাতাস, ততই যেন চেকভস্কি কাছে টেনে নিয়েছেন শেক্সপিয়রের সৃষ্টিকে। ইহুদি জীবনের যন্ত্রণার মধ্যে থেকেই একদিন এক অপেরা ‘দ্য মার্চেন্ট অফ ভেনিস’ মঞ্চস্থ করার পরিকল্পনা করে। সেখানে সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পান চেকভস্কি। অপেরার প্রথম দুটি অংশে দুটি সিন তৈরি করার কাজ চলেছিল ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত, কিন্তু হঠাৎ করে সেই সময় তিনি কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। কাজ হয়ে যায় বন্ধ। ডিরেক্টর হেয়ারউডের থেকে প্রত্যাখ্যানের চিঠি তাঁর জীবনে নেমে আসে আরও একটা আঘাতের মত।

অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে দিন চলতে থাকে তাঁর। ক্রমশই তিনি অনুভব করতে থাকেন, এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার দিন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ ইচ্ছে ছিল ‘দ্য মার্চেন্ট অফ ভেনিস’ যেন একদিন মঞ্চের আলো পায়। এরপর তিনি একটি উইল তৈরি করেন, এবং তাতে তিনি মেডিক্যাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য নিজের দেহ দান করে যান, আর মাথার খুলিটা দান করেন রয়্যাল শেক্সপিয়র কোম্পানিকে। তাঁর মৃত্যুর পঁচিশ বছর পর রয়্যাল শেক্সপিয়র কোম্পানি ঠিক করে এই খুলির ব্যবহার করা হবে তাঁদের পরবর্তী নাটক ‘হ্যামলেট’-এ, একেবারে সরাসরি, দর্শকদের সামনে। এর আগে অবশ্য এই খুলি শুধুমাত্র নাটকের রিহার্সালের সময়ই ব্যবহার করা হত। অবশেষে ২০০৮ সালে স্বয়ং শেক্সপিয়রের দেশ স্ট্রাডফোর্ড-আপন-এভনের কোর্টইয়ার্ড থিয়েটারে পরিচালক গ্রেগ ডোরান প্রথম এই খুলিকে মঞ্চে প্রদর্শন করেন। 

 

চেকভস্কির খুলি হাতে ডেভিড টিন্যান্ট

‘হ্যামলেট’-এর সেই ঐতিহাসিক সংলাপ– যেখানে রাজার বিদূষক ইয়রিকের খুলি হাতে হ্যামলেটের স্বগতোক্তি, “আহা রে জীবন! তোমাকে কতই না ভালবাসতাম আমি ইয়রিক।” জীবন কত নগণ্য! একদিন যে ইয়রিক সবাইকে আনন্দ দিয়েছে, আজ তার স্থান ভাগাড়ের এক কোণায়। এই নাটকে হ্যামলেটের চরিত্রে অভিনয় করেন অভিনেতা ডেভিড টিন্যান্ট। মঞ্চে তাঁর অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা ও যন্ত্রণাময় ভাষ্য যেন চেকভস্কির খুলি হাতে তাঁরই জীবনের গল্প বলে গেছে।

২০০৮-এর জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত স্ট্র্যটফোর্ড রয়্যাল শেক্সপিয়র কোম্পানিতে চেকভস্কির খুলি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু মজার বিষয়, জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে ভেবে আসল খুলির ব্যবহারের ঘটনাটি সকলের কাছে গোপন রাখা হয়। এইভাবে কয়েক মাস কাটার পর হঠাৎ একদিন আসল খুলির ব্যাপারটা সংবাদমাধ্যমের লোকজনের কাছে জানাজানি হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে নাট্যমঞ্চে খুলির ব্যবহার বন্ধ করার নির্দেশ দেয় রয়্যাল শেক্সপিয়র কোম্পানি। খুলি নিয়ে কবরখানার এই দৃশ্যটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুবই অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন চেকভস্কির এজেন্ট ও বন্ধু টেরি হ্যারিসন। তিনি বলেছিলেন, “আমি জানি শিল্পীরা অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ হন, সবার পক্ষে এমন একটি কাজ করাও সহজ নয়। কিন্তু ডেভিড টিন্যান্ট যে দক্ষতার সঙ্গে কাজটি করেছেন তা এককথায় অতুলনীয়।” চেকভস্কির খুলি নিয়ে শেষ পারফরম্যান্স হয় ১০ জানুয়ারি, ২০০৯ সালে। তার কিছু দিন পরেই বিবিসি এই নাটকটি ডকুমেন্ট আকারে তুলে রাখে। এই ডকুমেন্টেড কপিতে আবার চেকভস্কির খুলি ব্যবহার করা হয়।

নাটকের ইতিহাসে চেকভস্কির এই খুলি-দানের ঘটনাই কিন্তু প্রথম নয়। চেকভস্কির আগেও ১৮৯১ সালে জন রিড মৃত ইয়রিকের অভিনয় করার জন্য এই একই কাজ করে গিয়েছিলেন। চেকভস্কির মত অল্প দিনেই জগৎজোড়া খ্যাতি অর্জন করেননি বলে হয়ত অনেকেই আজ তাঁকে চিনবেন না। তাঁর থিয়েটার জীবন শুরু হয়েছিল ওয়ালনাট স্ট্রিট থিয়েটারের হাত ধরে। সেখানে তিনি প্রায় ৫০ বছর সামান্য গ্যাস জ্বালানোর কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এরপরে প্রায় ১১ বছর যুক্ত ছিলেন ফিলাডেলফিয়া থিয়েটারে একজন সামান্য কেরানি হিসেবে। মৃত্যুর আগে উইল করে তিনি বলে গিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দেহ সমাধি দেওয়ার আগে যেন তাঁর মুন্ডটি আলাদা করে সংরক্ষণ করা হয়, যাতে ওয়ালনাট স্ট্রিট থিয়েটারে ‘হ্যামলেট’ নাটক চলাকালীন নকল খুলির পরিবর্তে তাঁর আসল খুলিটি ব্যবহার করা যায়। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর পরিবারের লোকেরা মৃতের মুন্ডটি ওয়ালনাট স্ট্রিট থিয়েটারে দান করেন, এবং অবশিষ্ট দেহাংশ মাউন্ট ভার্ননের সমাধিক্ষেত্রে সমাধিস্থ করেন।

শোনা যায় ওয়ালনাট স্ট্রিট কর্তৃপক্ষ বেশ অনেক বছর ধরে ‘হ্যামলেট’ নাটকে জন রিডের খুলিটি মঞ্চে ব্যবহার করেন। নাটকের সংলাপ মেনে দেশ বিদেশের বহু বিখ্যাত অভিনেতারা যখন এই খুলি হাতে মৃত ইয়রিকের স্মৃতিচারণা করতেন, মঞ্চের আলো-আঁধারির মাঝে সত্যিই তা হয়ে উঠত অলৌকিক। আর এই অলৌকিক দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে হ্যামলেট-রূপী অভিনেতারা নাটকের শেষে কালো কালিতে সই করে যেতেন জন রিডের এই খুলির ওপর। বর্তমানে অবশ্য এই খুলি পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যান পেল্ট লাইব্রেরিতে সযত্নে রক্ষিত আছে।

জন রিডের খুলি হাতে এক অভিনেতা

এরপর ১৯৯৯ সালে ডেল ক্লোজ নামে একজন কৌতুক অভিনেতা শিকাগোর গুডম্যান থিয়েটারে নিজের খুলি দান করার কথা প্রকাশ করেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল এই খুলি যেন হ্যামলেট-সহ অন্যান্য নাটকে মঞ্চস্থ করা হয়। ডেল ক্লোজের এই খুলির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক মজার গল্প। একবার নাটক চলাকালীন বেশ কিছু সাংবাদিক লক্ষ্য করেন নাটকের মঞ্চে ব্যবহৃত খুলিতে মরচে ধরা বেশ অনেকগুলি স্ক্রুয়ের দাগ। তাঁরা সকলে থিয়েটার কর্তৃপক্ষকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাঁরা প্রকৃত তথ্য দিতে অস্বীকার করেন। পরে অবশ্য আসল ব্যাপারটি খোলসা করেন ক্লোজের সহধর্মিণী চার্না হ্যালপার্ন। রক্ষণাবেক্ষণের অসুবিধা এবং বারংবার মঞ্চে আসল খুলি ব্যবহার করার হাত থেকে বাঁচতে তিনি নিজেই একটি নকল খুলি (যা সেইসময় মেডিক্যাল বিভাগে পড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হত) দিয়ে এসেছিলেন থিয়েটার কোম্পানিকে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ডেল ক্লোজের আসল খুলিটি মর্যাদার সঙ্গে প্লাস্টিকের বাক্সতে ভেলভেট কাগজে মুড়িয়ে জনসমক্ষে শিকাগোর মিউজিয়ামে রাখা হয়েছিল।

প্লাস্টিকের বাক্সে সংরক্ষিত ডেল ক্লোজের খুলি

এসব ছাড়াও থিয়েটারের ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ মৃত ইয়রিকের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য নিজেদের দেহাংশ দান করে গেছেন। যেমন ধরা যাক কারপেন্টারের কথা। পেশায় ফার্মাসিস্ট এই ব্যক্তি ওয়ালনাট স্ট্রিট থিয়েটারে নিজের খুলি দান করে যান। উনবিংশ শতাব্দীতে তাঁর এই খুলি হাতে ন’জন অভিনেতা হ্যামলেটের দৃশ্যে অভিনয় করে গেছেন। তারপর যদি বলি ইংরেজ তারকা জর্জ ফ্রেডরিক কুকের কথা, তাঁর ইচ্ছা অনুসারে তাঁর মৃত্যুর পর সমাধি থেকে তাঁর খুলি বের করে মঞ্চে ব্যবহার করা হয়েছিল।

তবে নাটকের মঞ্চে আসল খুলির ব্যবহার নিয়ে থিয়েটার কোম্পানিগুলোকে প্রত্যহ কোনো না কোনো সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। ১৮৫০ নাগাদ সংবাদপত্রে বড়ো বড়ো হরফে এই নিয়ে প্রচুর সমালোচনা করা হয়। তাঁদের মতে নাটকের অভিনয়ে এই ধরনের প্রপসের ব্যবহার ‘...highly indecent, at the same time repulsive to the audience.’ তবু মানুষ ভালোবেসে এইসব নাটক দেখেছেন, দেখিয়েছেন, এবং আলোচনা করেছেন থিয়েটারের স্বার্থে এইসব মহান ব্যক্তিদের আত্মত্যাগ নিয়ে। দিনের শেষে এইসব অভিনেতারাও জায়গা পেয়েছেন নাটকের মঞ্চে, হ্যামলেটের সংলাপে, সর্বোপরি দর্শকের মননে। মৃত্যুর পরেও তাঁরা হয়ে উঠেছেন অমর।

তথ্যসূত্র:

Yorick's Afterlives: Skull Properties in Performance, Elizabeth Williamson, The Evergreen State College.